Wap4dollar.com

Tuesday 20 November 2018

আমার শায়খ সেইরকম ইসলামিক গল্প


"শায়খ"

পর্ব এক.....

সবসময় ভাবতাম বিয়ে মানেই এক প্লেটে দুজনের খানা

খাওয়া,গ্লাসের একই দিকে মুখ লাগিয়ে পানি পান

করা,একই মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করা.......

ইত্যাদি ইত্যাদি!!

শুধু অামি না,হিদায়াহর পর অাশি শতাংশ বোনের

চিন্তা-ই থাকে এমন।অামিও তাই এসব ভেবে পুলকিত

হতাম,সাজদায় গিয়ে অাকুল হয়ে রব্বকে নিজের

প্রয়োজন বলতাম,খুব শীঘ্রই বিয়ে হওয়ার জন্য দুঅা

করতাম।চোখে কেবল একটা স্বপ্ন থাকতো,একটা ছোট্ট

ঘর,বিছানায় একটা বালিশ,একটা প্লেট,একটা গ্লাস,কিছু

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র,কিছু তাফসীরের বই,দুইটা

কুরঅান,একটা জায়নামাজ............

ব্যস এতটুকুই!এতটুকু দিয়েই ছোট্ট একটা জান্নাত

সাজানোর স্বপ্ন দেখতাম অামি।

"বিয়ে" একটা ইবাদত হলেও,অামার চোখে তখন

"রোমান্টিসিজম" একটা ইবাদত ছিল।

বিয়ে মানেই যে কেবলমাত্র রোমান্টিসিজম নয়,বরং

অন্নেক.......

অঅঅন্নেক গভীর একটা ব্যাপার,তা বুঝলাম অামার

জীবনে শায়খ অাসার পর।

হু!'শায়খ'

অামি উনাকে শায়খ বলে ডাকি।উনি অালেম

নন,অালিয়ায়ও পড়েন নি তিনি,পড়েছেন জেনারেল

লাইনে।সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও পরিচিত মুখ নন তিনি।

তার একেকটা পোষ্টে কয়েকশত লাইক,শতাধিক

কমেন্ট,একগাদা শেয়ার হয়না।তারপরও তিনি এমন একজন

মানুষ,যাকে না দেখলাম বুঝতাম ই না,প্রকৃত দ্বীনদার

কেমন হয়।

পাঁচ ভাইয়ের মাঝে মেঝো জন অামার শায়খ।

জাহেলিয়াতে অাচ্ছন্ন পরিবারের সকল বিদ্রুপকে

উপেক্ষা করে তিনি অামাকে বিয়ে করেছেন

মাসজিদে,মোহর ছিলো দশহাজার টাকা......

কি নাক সিঁটকাচ্ছেন?ভাবছেন মাত্র দশ হাজার টাকা

কিসের মোহর!!

প্রতি মাসে নয়হাজার টাকা যার বেতন ছিলো,তার

পক্ষে কয়েক লাখ টাকা দেনমোহর দিতে বিলম্ব

হলেও,ধার্য করাটা নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিলো না।অামার

বাবা যখন পুরোই প্রশ্নবিদ্ধ মোহর নির্ধারণের এই অঙ্ক

দেখে,অামার শায়খ একদম প্রশান্তির হাসি হেসে

বলেছিলেন,"সাফিয়্যা মায়ের মোহর ছিল কেবলমাত্র

তার মুক্তি,অার বাকি অাম্মাজানদের মোহর বারো

উকিয়ার বেশী ছিলোনা।"

জানিনা বাবা কি বুঝেছিলেন,তবে এই নিয়ে অার

উচ্চবাচ্য করেন নি।

শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখলাম অামার হক্ব অাদায়ের জন্য

তিনি অালাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছেন।শ্বশুরবাড়ির

লোকজন কেউ অামাকে ওয়েলকাম তো করেইনি,বরং

বিদ্রুপের হাসি হেসেছিলেন।বড় জা তো টিপ্পনী কেটে

বলেই ফেলেছিলেন,

'অারও কত কি দেখব।বোরকা,নিকাব,মোজা পরে কোন

ভুতনি অাসছে কে জানে।'

অামার মন খারাপ হলেও শায়খের মুখে দেখেছিলাম

একগাল হাসি।হেসে হেসেই উনি বলে উঠলেন,সূরা

অাহযাব,অায়াত তেত্রিশ,অালহামদুলিল্লাহ,মাশাঅা

ল্লাহ.......

ওই মুহুর্তে লোকটাকে অামার পাগল ছাড়া কিছু মনে

হয়নি.....

অাশ্চর্য হয়েছিলাম রাত্রীবেলা......

বিয়ে নিয়ে একগাদা স্বপ্ন দেখলেও রাতটুকু নিয়ে অদ্ভুত

একটা চিন্তা ছিল।কিন্তু উনাকে দেখলাম বেশ হাসিমুখ

নিয়েই রুমে অাসলেন,অামায় চড়া গলায় সালাম

দিলেন,এবং অামার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজলেন।

অামি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে ছিলাম,কি করা উচিৎ

মাথায় অাসছিলো না।এরই মাঝে উনি গুণগুণ করে পড়া শুরু

করেছেন,

"হাল অাতাকা হাদিসুল গশিয়াহ.......

উ জুহুই ইয়াওমা ইযিন খশিয়াহ......

অামিলাতুন নছিবাহ.........

........................

............................

................................

সুম্মা ইন্না অালাইনা হিসাবাহুম!"

যতটা সময় উনি পড়ছিলেন অামি মন্ত্র মুগ্ধের মতন উনার

দিকে তাকিয়ে ছিলাম।বারবার মাথায় বাড়ি

খাচ্ছিল,এটা সুন্নাহ না?রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি

ওয়া সাল্লাম তো অাম্মাজানের কোলে মাথা রেখে

কুরঅান তিলাওয়াত করতেন.......

কি একটা প্রশান্তি!কি অদ্ভুত প্রশান্তি!অামি কেঁদে

ফেলেছিলাম।উনি কোল থেকে মাথা না সরিয়েই

অামায় জিজ্ঞাস করলেন ইশা পড়েছি কিনা।অামি না

সূচক মাথা নাড়তেই উনি একলাফে উঠে

পড়লেন,নির্দেশের স্বরে ইশা পড়তে বললেন।

অামিও ইশার স্বলাত অাদায় করলাম।সাজদায় গিয়ে

অার মাথা তুলতে পারছিলাম না।কান্নায় ভেঙে

পড়েছিলাম।কিসের কান্না বুঝিনি,শুধু কেঁদেই

গেছিলাম।স্বলাত শেষ করে উঠেই দেখি তিনি

তন্দ্রাচ্ছন্ন।অামিও অার না ডেকে ঘুমিয়ে পরি।রাতের

খাওয়াটুকুও হয়নি সেদিন।মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো

চোখেমুখে হালকা মতন পানির ছিটা লাগায়।উঠে দেখি

উনি বড় বড় চোখে তাকিয়ে অাছেন,ঘড়িতে সবে

অাড়াইটা বাজে।ফজরের এখনও ঢের বাকি।উনি এত

তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙালেন কেন!

উঠে বসতেই উনি যন্ত্রের মতন বলে চললেন....

"এত গাঢ় ঘুম কারও হয়?রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ডেকে

দেননি কেন? রাতে নিশ্চয় না খেয়ে ছিলেন?শরীরের

একটা হক্ব অাছে না?নিশ্চয় খিদা লেগেছে।তাড়াতাড়ি

উঠুন,হাতমুখ ধুয়ে অাসুন,অামি তরকারি গরম করেছি।ভাত

বাড়ছি চলুন........"

উনি এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন অামি উনার কত

দিনের চেনা।কথায় একটুও জড়তা নেই।অামার একটু

অস্বস্তি লাগলেও ভালই লাগছিল।ফ্রেশ হয়ে অাসতেই

দেখি উনি খাবার সামনে নিয়ে বসে অাছেন।তবে এক

প্লেটে না,অালাদা অালাদা প্লেটে,গ্লাস ও দেখছি

দুইটা......

অামি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম,কোলে

মাথা রেখে কুরঅান তিলাওয়াত করা সুন্নাহ,এটা

জানেন,অার একই পাত্রে,একই গ্লাসে খাওয়া যে

সুন্নাহ,ওটা কি তিনি জানেন না?

চাপা একটা অভিমান জমা হলো মনে।অভিমান নিয়েই

খেতে বসলাম................

চলবে ইনশাআল্লাহ!




"শায়খ"

পর্ব দুই.....

খাওয়ার সময় লক্ষ করলাম তিনি সবকিছুই ঠিকঠাক

রেখেছেন।অর্থাৎ দস্তরখানা বিছিয়েছেন,এক হাঁটু

বিছিয়ে অারেক হাঁটু উঠিয়ে বসলেন,শব্দ করে

বিসমিল্লাহও পড়লেন...........

সামনে থেকে অল্প অল্প করে খাচ্ছেন,খাওয়া শেষে

হাতের অাঙুলগুলো যথাক্রমে মধ্যমা,শাহাদাত,বৃদ্ধা

অাঙুল চেটে খাচ্ছেন।পানি খাওয়ার সময়ও দেখলাম

একাগ্রতা!

বিসমিল্লাহ বলে ডান হাত দিয়ে গ্লাস ধরে তিন

নিঃশ্বাসে পানি পান করলেন।

এমনকি খাওয়া শেষে দস্তরখানা অাগে উঠিয়ে,তারপর

তিনি জায়গা থেকে উঠেছেন।

অামার অশান্তি লাগছিল.......

যে লোকটা এতকিছু মেইনটেন করেন,সে স্ত্রীর সাথে

একই পাত্রে খেলেননা কেন?!মনে এক ধরণের ক্ষোভ সৃষ্টি

হচ্ছিল।অাসলে কিছু পুরুষ থাকেই এমন,দেখা যায় হজ্জ

করে এসেছে,অথচ স্ত্রীর সাথে ভালবাসা প্রকাশ করেন

কম,হায়েজের সময় স্ত্রীকে অশুচি মনে করেন,এমনকি

স্ত্রীকে সবসময় নিচু চোখে দেখেন!

উনিও বোধহয় তেমনই!গা জ্বলে যাচ্ছিলো রাগে।মন

চাচ্ছিল অায়শা অাম্মাজানের মতন করে প্লেট টা

ভেঙে ফেলি!!

খাওয়া বন্ধ করে রাগে ফুঁসছিলাম,উনি কোথায়,কি

করছেন সেদিকে খেয়ালও ছিল না।একদৃষ্টে ভাতের

দিকে তাকিয়ে অাছি,এমন সময় কানে গরম নিঃশ্বাস

অনুভব করলাম!কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে

বললো,

"অাউযুবিল্লাহ পড়ো,রাগ জাহান্নাম থেকে অাসে"

চমকে তাকিয়ে দেখি উনি,অামার শায়খ,একগাল হাসি

নিয়ে অামার দিকে চেয়ে অাছেন।অামি অাবারও

হতবাক,এই মূহুর্তে কি করা উচিৎ সেটাই খুঁজে পাচ্ছিনা।

অন্য কেউ হলে হয়তো লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলতো।

কিন্তু অামি অপলক চেয়ে ছিলাম।হাসিতে দাঁতের মাড়ি

দেখা যাচ্ছে,লম্বাটে চেহারা,গালভর্তী দাঁড়ি,হাসির

চোটে তার চোখগুলোও যেন হাসছে,নাকে একটা

কালোমতন দাগ..... অাঘাত পেয়েছেন মনে হয় কখনও.........

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা,হুশ ফিরলো উনার চোখ

মারা দেখে।

জ্বি হ্যাঁ!ঠিকই শুনেছেন,অামার চাহনী দেখে অামায়

পরপর তিনবার চোখ মারলেন উনি!!

হুজুর মানুষ চোখ মারে.......

ভাবা যায়!!!

লজ্জায় চোখ নামিয়ে উনার মুখে মুখে অাউযুবিল্লাহ

পড়লাম।ধীরে সুস্থে খাবার শেষ করলাম।ঘড়িতে দেখি

তিনটা পনের বাজে।তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য অযু করে

এলাম।এসে দেখি উনি বৈঠকে অাছেন।সম্ভবত তাশাহুদ

পড়ছেন,অামি অাবারও খেয়াল করলাম তাকে।চোখেমুখে

কি একটা প্রশান্তি,ঠোঁটে একপ্রকার হাসির অাভা

লেগে অাছে।মনে হচ্ছে তিনি বুঝি তার খুব কাছের কারও

সাথে খোশগল্পে মগ্ন!অামি অভিভূত হয়ে তাকিয়ে

ছিলাম।উনাকে সালাম ফেরাতে দেখে অামি তড়িঘড়ি

করে চোখ নামালাম।উনি অামায় নামায পড়তে বলে

বিছানায় বসলেন।অামি স্বলাত শেষ করে দেখি এখনও

চারটা বাজেনি।ফজরের ওয়াক্ত শুরু হবে পৌনে পাঁচটায়।

ভাবলাম একটু কুরঅান পড়বো,কিন্তু এখানে কুরঅান

কোথায় তা তো জানিনা.......

উনাকে জিজ্ঞাস করতেই উনি অামায় বিছানায় বসতে

বললেন।অাবারও রাতের মতন অামার মাথায় কোল

রেখে......

ইশ!না না!কি সব বলছি!

অামার কোলে মাথা রেখে বললেন,

"চলো মুখে মুখে পড়বে।বলো অাউযুবিল্লাহ...

...................

বিসমিল্লাহ................

হাল অাতাকা হাদিসুল গশিয়াহ......."

অামিও পড়া শুরু করলাম,

'হাল অাতাকা হাদিসুল গশিয়াহ!

উ জুহুই ইয়াওমা ইযিন খশিয়াহ......

অামিলাতুন নছিবাহ.........

................

.....................

..........................."

উনার মুখে মুখে পড়ছিলাম।কখনও কখনও একটা অায়াতকে

কয়েকভাগে পড়েছি,ধীরে ধীরে পুরো সূরা শেষ করলাম।

অামি মন্ত্রমুগ্ধ!এই মানুষটাকে বুঝতে পারছিনা!কখনও

ভাবিনি এভাবে কুরঅান পড়বো,কখনও এভাবে কুরঅান

পড়ার স্বপ্ন দেখিনি।মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় অামি

একাকার হয়ে ছিলাম।না চাইতেই এত বড় একটা ঘটনার

সাক্ষী করেছেন অাল্লাহ অামায়!কৃতজ্ঞতায় চোখে

পানি চলে এলো!মনে মনে শুধু পড়ছিলাম,'অালহাম

দুলিল্লাহ!অালহামদুলিল্লাহ!অালহামদুলিল্লাহ অালা

কুল্লি হাল......'

সূরাটা শেষ করেই তিনি বলা শুরু করলেন,

--বলোতো অামিনা,এটা কোন সূরা ছিলো?

--অাল গশিয়াহ।

--জানো এটা মাক্কি সূরা,গাশিয়াহ কিয়ামতেরই

অারেকটা নাম,অামি রাতেও এটা পড়েছিলাম,মনে

অাছে?অামার খুব প্রিয় সূরা এটা।তোমার ভাল লাগেনা

সূরাটা?

--অামি তো অালাদাভাবে কখনও ভাবিনি এটা নিয়ে।

তবে ভালই লাগে....!

--হ্যাঁ!হ্যাঁ!ভাল লাগবেনা কেন বলো?এটাও তো তোমার

অামার রব্বেরই বাণী,তাইনা?পাশাপাশি সূরাটায়

দেখো,প্রথম সাত অায়াতে কিয়ামতের কথা,

জাহান্নামের কথা,জাহান্নামীর শাস্তির কথা বলা

অাছে।তারপর অাট থেকে ষোল অায়াতে কেবলমাত্র

তাদের কথা বলা হয়েছে,যা অামরা সবাই হতে চাই।

বলোতো কাদের কথা?

--কাদের কথা?বলতে পারছিনা!অামি কখনও অর্থসহ

পড়িনি সূরাটা!

--কেন পড়োনি অামিনা!অাল্লাহর প্রথম বাণীই তো

হলো,ইকরা।পড়ো......

পড়ার তাগিদ স্বয়ং তোমার অামার রব্ব দিয়েছেন।

তারপরও পড়োনি কেন?অাচ্ছা পড়োনি সমস্যা নেই।

অামার সাথে পড়বে।এখন শুনো কি বলি.....

এই অামিনা!শুনছো?নাকি ঘুম অাসছে?

--না না!শুনছি,অাপনি বলুন।

--হ্যাঁ শুনো,পরের ষোল অায়াত অবধি অাল্লাহ

জান্নাতিদের কথা বলেছেন।তারপর সরাসরি অস্বীকার

কারীদের,অবিশ্বাস কারীদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন,কি

প্রশ্ন ছুঁড়েছেন জানো?তিনি প্রশ্ন ছুঁড়েছেন,সৃষ্টি

নিয়ে,এই উট,অাকাশ,পাহাড়,জমিন নিয়ে.....

প্রকৃতির ভারসাম্য নিয়ে।তারপর রসূলুল্লাহকে উপদেশ

দেওয়ার অাদেশ করে অাবার মনে করিয়ে দিয়েছেন

যে,অামাদের সবাইকে তার কাছে ফিরে যেতে হবে।

অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে তিনিই হিসাব নিবেন......

এই অামিনা,জানো এই অায়াতটা যখন পড়ি,

"ইন্না ইলাইনা ইয়াবাহুম" কেমন স্বস্তি লাগে!!একদিন

অামরা অামাদের রব্বের কাছে যাব।তখন কি হবে বলো

তো?খুব লোভ হয়,ওই অায়াতটা শুনতে।কোন অায়াতটা

জানো,ওই যে......

--সালামুন ক্বওলাম্মির রব্বির রহীম,তাইনা?

--হ্যাঁ,হ্যাঁ,সূরা ইয়াসিনের অাটান্ন নং অায়াত টা......

দূর থেকে অাযান শোনা যাচ্ছে,তিনি অামার কোল

থেকে মাথা উঠিয়ে ইস্তেঞ্জায় গেলেন,ওযু করে এসে দুই

রাকাত নামায পড়লেন।তারপর অামার দিকে তাকিয়ে

বললেন,

"চলো অাজকে অামি জামাঅাত করে নামায পড়াই।তুমি

পিছনে দাঁড়াও অামার।এসো....... "

অামি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি।অার পাঁচটা বাসর

রাত কেমন হয় অামি জানিনা।তবে অামার বাসর রাত

অাল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ,একদম পরিপূর্ণ........

অাল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা ভরে মাথা নোয়ালাম অামি।

কে জানে,এত প্রশান্তিময় সাজদা হিদায়াহর পর অাগে

কখনও দিতে পেরেছিলাম কিনা!

ইনশাআল্লাহ চলবে.............




"শায়খ"

পর্ব তিন......

ফজরের পর অামি মূর্তির মতন বসে ছিলাম।নতুন বউ

হিসেবে ফজরের পর কি করা উচিৎ অামি বুঝতে

পারছিলাম না।তারউপর রাত অাড়াইটা হতে জেগে

অাছি।বালিশে একটু হেলান দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম।ঘুম

যখন ভাঙলো,তখন বড় জার বিদ্রুপ শুনতে

পাচ্ছিলাম,ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে......

অামায় উঠে বসতে দেখে বড় জার টিপ্পনী শুরু হলো......

--ও মা,এই ঘরে অাসেন।নবাবজাদির ঘুম ভাঙছে।হিহি....অ

ামার বিয়ের পরদিন অামি কোন সকালে উঠছিলাম,অার

এই মেয়ে!!

মা গো মা!!গোসলও করোনি এখনো!ছিহ!কি অশুচি!নাপাক

একটা মেয়ে......

এতকিছু জানো,অার এটা জানোনা যে, গোসল কখন ফরজ

হয়?কি লজ্জা!ও মা দেখে যান,অাপনার ছেলে মসজিদে

গিয়ে কোন খবিশকে তুলে অানছে.........

অারও কতক্ষণ চলতো উনার টিপ্পনী কাটা কি জানি!

অামি উনার কথার মাঝেই বলে উঠলাম....

--অাসসালামু অালাইকুম!কেমন অাছেন অাপা?

--কিসের অাপা?বড় বউ অামি এই সংসারের,ভাবি

ডাকবে,বুঝছো?সালাম দিয়ে নিজেকে পীরনি ভাবো?

এহহ!অাইছে বড় পীর!যাও গোসলে যাও।নাপাক

কোথাকার।কেন যে এই নাপাকের ঘরে অাসছি,কে

জানে!থুঃ!

কি অদ্ভুত মানসিকতা!যা তা বলে চলে গেলেন।উনি বের

হয়ে যাওয়ার পরপরই শায়খ এলেন ঘরে।

--অাসসালামু অালাইকুম!ঘুম ভাঙলো?

ক্লান্ত ছিলে বলে ঘুমিয়ে পরেছিলে,তাই অার ডাকিনি।

কিছু তো খাওনি না?ইশ!খাবে কিভাবে?এখনও তো

হাতমুখও ধোও নি।যাও তুমি হাতমুখ ধুয়ে অাসো।

--ওয়া অালাইকুমুস সালাম!অাসলে....

অামি তো মিসওয়াকের জন্য কিছু অানি নি।

--ওহ।!অামার একদম মনে ছিলোনা,দাঁড়াও অামি এখনই

ব্যবস্থা করি।

দুই মিনিটের মাথায় কোথা থেকে একটা ডাল এনে

দিলেন তিনি।অামার অাবারও প্রচুর অভিমান হলো।

নিজেরটা দিলে কি হতো যে অারেকটা এনে দিতে

হলো?সুন্নাহ তো একই ডাল দিয়ে দুজনের মিসওয়াক

করা।লোকটার মনে হয় শূচীবায়ু অাছে।সেসব নিয়ে না

ভেবে ইস্তেঞ্জায় গেলাম।এসে দেখি ওমা!উনি প্লেট

সাজিয়ে বসে অাছেন।এই লোকটা কি খাওয়া ছাড়া কিছু

বুঝেন না?রাত অাড়াইটা বাজে খেলেন,এখন অাবার

সকাল অাটটা বাজতে না বাজতেই....!

কি অদ্ভুত!অামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই বলা

শুরু করলেন,

--অাজ তো ওয়ালিমা অাছে।সারাদিন ঝামেলায়

কাটবে।কখন খানা কপালে জুটবে কে জানে।তুমি

বসো,কয়েকটা খেঁজুর খাও অাগে।এগুলা অাজওয়া

খেঁজুর,দেশে পাইনি,সৌদি থেকে অানিয়েছি।জমজমের

পানি ছিলো,শেষ হয়ে গেছে।নরমাল পানি দিয়েই খাও।

শুনো ঘর ঝাড়ু দেওয়া হয়ে গেছে।রাতে খেয়েছিলাম

যে,প্লেট বাটি ধোয়াও শেষ।এখন কাজ বলতে,বিছানাটা

গুছানো বাকি,অার...........

অাচ্ছা,বাদ দাও।তুমি অাজ বিছানাটা গোছাও।কাল

থেকে অামিও জয়েন করব ইনশাআল্লাহ!এসে তাড়াতাড়ি

খাও।অামাকে অাবার ওদিকে যেতে হবে।ওয়ালিমার

কাজে কোনও ত্রুটি যেন না থাকে,তা নিশ্চিত করতে

হবে।শুনো,তুমি ঘর থেকে নড়িও না।অামি দেখছি মাকে

বুঝিয়ে পাঠাচ্ছি তোমার কাছে।এখনও দাঁড়িয়ে কেন?

বসো।

এবার খেয়াল করে দেখলাম,প্লেট একটা হলেও গ্লাস

কিন্তু দুইটাই অাছে।খাওয়ার এক পর্যায়ে,উনি অাচমকা

অামার থুতনিটা তুলে ধরে কিছু একটা খাইয়ে দিলেন।

অামি একটু চিবিয়েই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে

অাছি,অার উনি খিলখিল করে হাসছেন।হাসতে হাসতে

পেট চেপে ধরেছেন!কি অদ্ভুত!উনি অামার মুখে খেঁজুরের

পরিবর্তে সুপারির দানা গুঁজে দিয়েছেন।তাও

এক্কেবারে কাঁচা!ইশ!কি বিদঘুটে স্বাদ!!

--বুঝলে অামিনা,মাঝে মাঝে অাহলিয়ার সাথে মজা

করা লাগে।তাকিয়ে দেখছো কি?মুখ থেকে ফেলো ওটা।

কস লাগছে না?ফেলো।বাকিটা খেয়ে শেষ করো,অামি

যাই কেমন?

হনহন করে বেরিয়ে গেলেন এইটুকু বলে।উনি চলে

যাওয়ামাত্র অামার হাসি পেলো।অামি শব্দ করে হেসে

ফেললাম।যাহোক,উন

ি বলে গিয়েছিলেন মাকে পাঠাবেন।কিন্তু প্রায় ঘন্টা

দুয়েক পার হওয়ার পরও মা অাসেন নি।অামার প্রচণ্ড

একা লাগছিলো।কয়েকবার ভাবলাম,বের হয়ে দেখব।

কিন্তু অচেনা জায়গা,তারউপর উনি বারণ করেছেন,তাই

অার বের হইনি।বাবাকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বললাম।

তারপরও সময় কাটছিলো না দেখে ফেসবুকে লগিন

করলাম,রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলালাম,অাপুদের সাথে

কিছুক্ষণ অাড্ডা দিলাম।তারমাঝেই বড় জা এসে

পরেছেন।

--তোমার মত মেয়ে অামি জন্মে দেখিনি।কোথায় সকাল

সকাল উঠে শ্বশুর শ্বাশুরির সেবা করবে,তা না।মোবাইল

টিপছো।অবশ্য এটাই তো হওয়ার কথা।যেমন দেবা,তেমন

দেবী।এখন শুনো কি বলি,এত দেরী করে ঘুম ভাঙলো কেন?

রাতে কয়বার.....

হিহি!হাহাহা!ওমাগো!তবে হয়নি বলেই তো মনে হয়।

অামার দেওর কি পুরুষ নাকি?নপুংসক বলেই মনে হয়।না হয়

নাবিলা মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে যাবে কেন?নিশ্চয়

কিছু গরমিল অাছে।নাহয় এত ভাল......

নাবিলা!!!!!!

চমকে উঠলাম অামি!!

উনি বকবক করেই যাচ্ছেন।অামার সেদিকে খেয়াল নেই।

অামার শুধু রাতের কথা মাথায় ঘুরছে।সত্যিই তো উনি

অামার কাছে অাসেন নি।তাছাড়া এই নাবিলা টাই বা

কে?উনার প্রাক্তন?কই!অামায় তো বলেন নি।অস্থির

লাগছিলো।চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব

করছিলাম,সেটা মাথার একপাশে নাকি বুকে কে

জানে........

কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম,

--অাপা!নাবিলা কে?

--অাবার অাপা?মা বাবা কি এতটুকু শিখিয়ে পাঠায়নি

যে,ঘরের বউকে ভাবি বলা লাগে?অবশ্য কি শেখাবেন

অার?কোনও মতে চোরের মতন গছিয়ে দিয়েছেন

মেয়েকে।অামার বিয়েতে সারে চার ভরি স্বর্ণ

এসেছিল,অার তোমার?হাহ!নাবিল

া তোমার বরের কোন জান্নাতি হুর,সেটা তোমার বর

থেকেই জেনে নাও।যত্তসব!

রাগে গজগজ করে চলে গেলেন উনি।এদিকে অামার

মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।নাবিলা কে?উনার প্রেমিকা?

নাকি প্রথম স্ত্রী?

কই উনি তো বলেন নি উনি ডিভোর্সি কিনা!

তাহলে?

নাকি সত্যিই উনি নপুং......

না না!কি সব ভাবছি!কিন্তু উনি ই বা কাল অামার কাছে

এলেন না কেন!!

ভাবছিলাম,অার তড়পাচ্ছিলাম!প্রচুর কষ্ট হচ্ছিলো........

.......

ওয়ালিমায় বাবা মা এসেছিল।ছোট বোনটার গায়ে

নাকি কে মরিচের গুড়া গোলানো পানি মেরেছে,সেসব

নিয়ে ব্যস্ত সবাই।অামার সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই!

দুপুরে এলেন উনি।কিছু প্রয়োজন কিনা খোঁজখবর নিলেন।

অাবার চলে গেলেন। সারাদিন অার দেখা নেই।ফিরলেন

মাগরিবের পর।অামি কিন্তু ততক্ষণ না খেয়ে অাছি।

অাসলে খিদার কষ্ট অনুভবই হচ্ছিলো না।মাথায় শুধু

'নাবিলা','নপুংসক' শব্দগুলো ঘুরছিলো।সারাদিন

কোনওমতে চোখের পানি অাটকে রেখেছিলাম।যখনই

উনি ঘরে এসে সালাম দিলেন,অার অাটকাতে পারিনি।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।খুব চেষ্টা করে শুধু এটুকু

জিজ্ঞেস করলাম,

'নাবিলা এখন কোথায়?'

উনি অামার পাশে বসেই অামার কাঁধে হাত রেখে

কান্নার কারণ জানতে চাচ্ছিলেন।প্রশ্ন শুনে এক ঝটকায়

উঠে দাঁড়ালেন।তার চোখে রাগ নাকি ভয় বুঝতে

পারছিলাম না।কিন্তু সেটা মূহুর্তের জন্যই।তারপরই ফিক

করে হেসে দিলেন তিনি।জড়তাহীন কণ্ঠে জবাব দিলেন,

--নাবিলা বড়ভাবির বাবার বাড়িতে,হটাৎ এই প্রশ্ন কেন?

তাছাড়া তুমি নাবিলার কথা জানলেই বা কি করে?

জেনেছ বেশ ভাল!এটা নিয়ে কাঁদার কি অাছে শুনি?ভয়

হচ্ছে?অামাকে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে?হাহাহা!

ভালবেসে ফেলেছ অামাকে?এক রাতেই?হোহোহো!সব

বাদ দাও,খিদা লেগেছে?কিছু খাবে?অাচ্ছা,পরে খেও।

জানো অাজ কি হয়েছে,অামার ছাত্র এসেছিল

ওয়ালিমায়........

উনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথা বলছেন।এদিকে অামি

তড়পাচ্ছি!উনি কি লুকাচ্ছেন অামার থেকে?উনাকে তো

বেশ দ্বীনদার ই মনে হচ্ছিলো সকাল থেকে।তাহলে কি

সবই নাটক?ভণ্ডামী!!

ইনশাআল্লাহ চলবে........






"শায়খ"

পর্ব চার.........

উনি যত অামার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন,অামার মনে

সন্দেহ তত ভীড় করছিলো।এশার পর তিনি অাবারও

অামার কোলে মাথা রেখে কুরঅান তিলাওয়াত

করেছেন.........

'ওয়াত্বুর....

ওয়া কিতাবিম মাস্তুর.....

ফি রক্কিম মানসুর......

....................

..................

ইন্না অাজাবা রব্বিকা লাওয়াক্বিউ.......

.......................

.......................

ইয়াওমা ইয়ুদা'উনা ইলা নারি জাহান্নামা দা'অা.........

.....................

.....................

ওয়া মিনাল্লাইলি ফাসাব্বিহ হু ওয়া ইদ বারন নুজুম!'

অামি খেয়াল করলাম তিনি সূরাটা তিলাওয়াত করার

সময় কিছুকিছু জায়গায় এসে কেঁদে ফেলছিলেন।অবাক

লাগলেও অামলে নিই নি।অামি নিশ্চুপ মুর্তির মতন বসে

ছিলাম।গতকাল কোলে মাথা রেখে কুরঅান

তিলাওয়াতের এই ঘটনা অামায় যতটা অান্দোলিত

করেছিল,অাজ তার সিঁকি ভাগও করছেনা।বোধ হয়

অামার মূর্তরূপ দেখে তিনি বলা শুরু করেছেন,

--অামিনা!তোমায় হতাশ দেখাচ্ছে কেন?

--কই নাতো.....

--অবশ্য এই সূরাটা পড়লে হতাশ হওয়ারই কথা।ভয় করছে

তোমার,তাইনা?

--না তো!কেন ভয় করবে?তাছাড়া এই সূরার বাংলা অর্থ

কখনও পড়িনি,তাই.......

অাসলে অামি........

--ঠিকাছে সমস্যা নেই।পড়োনি তো এখন পড়বে।রোজ

একটা সূরার কমপক্ষে বিশ অায়াত অর্থ অার তাফসীর সহ

পড়বে কেমন?

--ইনশাআল্লাহ পড়বো।

--এখন শুনো,এই সূরাটা বুঝিয়ে দিই তোমাকে।এই সূরাতে

প্রথমে তূর পাহাড়ের শপথ নেওয়া হয়েছে।তূর পাহাড়

কোনটা জানো?মূসা অালাইহিস সালাম যেই পর্বতে

দাঁড়িয়ে তোমার অামার রব্বের সাথে কথা বলতেন,সেই

পাহাড়ের নাম।তারপর শুনো তারপর কিতাবের

নামে,বায়তুল মামুরের নামে কসম করা হয়েছে।বলোতো

বায়তুল মামুর কি?

--নিশ্চিত না,তবে একটা অার্টিকেলে

পড়েছিলাম,বাইতুল মা‘মুর হলো সপ্ত আকাশের ওপর

অবস্থিত সে ইবাদতখানা যেখানে ফেরেশতারা ইবাদত

করেন। এ ইবাদতখানা ফেরেশতাগণের দ্বারা এমনভাবে

পরিপূর্ণ হয়ে থাকে যে, প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার করে

ফেরেশতা ইবাদতের জন্য প্রবেশ করেন। যাদের কিয়ামত

পর্যন্ত পুনরায় প্রবেশের পালা আসবে না।

--মাশাঅাল্লাহ!সঠিক বলেছ।অাসলে সপ্তম আসমানে

বসবাসকারী ফেরেশতাদের কা'বা হচ্ছে বায়তুল মামুর। এ

কারণেই মেরাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে পৌঁছে ইবরাহীম

আলাইহিস সালাম-কে বায়তুল মামুরের প্রাচীরে হেলান

দিয়ে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পান।কেননা দুনিয়ার

কাবা তো তিনিই নির্মান করেছেন।

তারপর শুনো,তোমার অামার রব্ব কসম করেছেন অাকাশের

অার সমুদ্রের নামেও।এখন তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে

পারে,অাল্লাহ যা বলবেন,তা তো সত্যিই বলবেন।তাহলে

এতবার এতকিছু নিয়ে কসম কাটছেন কেন,তাইনা?

--হু,তা ঠিক।বারবার কসম কাটার কি প্রয়োজন ছিল?

--অামরা কেন কসম করি বলোতো?বিশ্বাসযোগ্যতা

বাড়াতে,তাইনা?কেউ অামাদের কথা বিশ্বাস না

করলেই অামরা শপথ করে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াই।কিন্তু

তোমার অামার রব্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।

খেয়াল করলে দেখবে,তিনি তখনই কসম করেছেন,যখন খুব

খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলেছেন।পাশাপাশি কুরআন মাজীদে

বিভিন্ন স্থানে যে বিভিন্ন কসম করা হয়েছে তার

উদ্দেশ্য কথাকে সৌন্দর্যমন্ডীত, অলংকারপূর্ণ ও বলিষ্ঠ

করে তোলা,বুঝলে?

--হ্যাঁ,বুঝলাম।

--দেখ এই সূরার মূল বিষয় কি!কিয়ামতের বর্ণনা,জাহান্না

মের শাস্তি,জান্নাতের প্রাচূর্য্য,এবং অামাদের

দায়িত্ব।বুঝলে না তো?

খেয়াল করলে দেখবে এর ছয় থেকে ষোল নং অায়াতে

কেবলমাত্র কিয়ামতের ভয়াবহতা অার জাহান্নামীর

শাস্তির কথা বলা অাছে।তারপর পরই দেখ, সতের থেকে

অাটাশ নং অায়াত পর্যন্ত বলা অাছে জান্নাতের বিবরণ

সম্পর্কে।

--জান্নাতের বিবরণ?!!কি কি বিবরণ!!

--এটাই যে,ওখানে থাকবে প্রাচুর্যতা।অার

......

উঁহু বলবনা।এটা তুমি পড়ে নিবে।তারপর রব্বে কারীম

অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়েছেন,স্রস্ট

া সম্পর্কে,সৃষ্টি সম্পর্কে,তাদের কর্ম সম্পর্কে।অার

তারপরই অাল্লাহ তাঅালা অামাদের কর্ম,অামাদের

দায়িত্ব সম্পর্কে অালোকপাত করেছেন।কি কি দায়িত্ব

জানো......?!

--না,অাপনি বলুন।

--"ওয়াছবির লিহুকমি রব্বিকা ফা ইন্নাকা বিঅা'ইউনিনা

ওয়া সাব্বিহ বিহামদি রব্বিকা হিনা তাকুম"

এটা শেষ অায়াতের অাগের অায়াত।এটাতে বলা অাছে

অামাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে,তারপরই বলা হয়েছে

রব্বের তাসবীহ পাঠ করতে।

তারপরের অায়াত দেখ,ওটাতে বলা অাছে,

"ওয়া মিনাল্লাইলি ফাসাব্বিহ হু ওয়া ইদ বারন নুজুম"

এখানে অাদেশ অাছে রাতের বেলা,শেষ রাতে অার

নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার পর রব্বের তাসবীহ পাঠ করার,রব্বের

মহীমা ঘোষণা করার।যদিও এটা রসূলুল্লাহর প্রতি উপদেশ

ছিলো,তথাপি এটা অামাদের জন্যও প্রযোজ্য।এই

অামিনা,দরুদ পড়বে না?পড়ো সল্লাল্লহু অালাইহি ওয়া

সাল্লাম।রসূলুল্

লাহর নাম নিলে দরূদ পড়া লাগে তো।গতকালও দেখলাম

তুমি অামায় মনে করিয়ে দাওনি।

--অাফওয়ান!অামার মনে ছিল না।সল্লাল্লহু অালাইহি

ওয়া সাল্লাম।কিন্তু,মানে টা বুঝলাম না!এখানে কি

তাহাজ্জুদের কথা বলা হয়েছে।

--শুধু তাহাজ্জুদ না,বরং মাগরীব,ইশা এদুটোও এই রাতের

ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত,

সাধারণ তাসবীহ পাঠ এবং আল্লাহর যিকরও বুঝানো

হয়েছে।

--অার নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার পর মানে?কোন সময়?কিসের

ইবাদত?

--এটা সম্ভবত ফজরের স্বলাতের পূর্বের দুই রাকাত সুন্নত

স্বলাতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

অামি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অাছি।এই লোকটা

এত জানে কিভাবে?মাশাঅাল্

লাহ!!মাশাঅাল্লাহ!!

কিছুক্ষণের জন্য অামার মনেই ছিলোনা,'নাবিলা' অার

'নপুংসক' শব্দ দুইটার কথা।মনে পড়লো,যখন তিনি অামাকে

কাছে টেনে নিলেন।অামি প্রবল অস্বস্তিতে ভুগছিলাম।

একদিকে 'নাবিলা' রহস্য জানার অাগে অামি তাকে

এক্সেপ্ট করতে পারছিলাম না।অন্যদিকে তাকে বাধাও

দিতে পারছিলাম না,কেননা তিনি অামার উপর অসন্তুষ্ট

হয়ে রাত্রীযাপন করলে অামি গুনাহগার হব।তবুও অস্পষ্ট

কণ্ঠে বললাম,

--অাই থিংক অাই নিড সাম টাইম....

--এন্ড সাম স্পেস অলসো,রাইট?

তার কথার ধরণ দেখে অামি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।

কি অবলীলায়,জড়তাহীন কণ্ঠে কথাটা বলেছেন।যেন

তিনি অাগে থেকেই জানতেন অামি এমন কিছু বলব।অার

মুখে কি প্রশস্ত হাসি!!একদম পবিত্র একটা হাসি।নাহ!এই

মানুষটা অার যাই হোক,অামাকে ঠকাতে পারেন না।

কিংবা এমন কিছু করতে পারেন না,যা অামায় কষ্ট

দিবে।অামার হক্ব নষ্ট করবে।অামি তবুও সাহস করে

অাবার নাবিলার প্রসঙ্গ তুললাম।জানতে চাইলাম কে এই

নাবিলা।তার খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিলো,

--তুমি এখনও এসব নিয়ে পরে অাছ?অাচ্ছা পাগলী তো

তুমি।অবশ্য এমন পাগলি ই অামার পছন্দ।এই অামিনা,এসো

শুয়ে পরি।অার তোমায় একটা গল্প শোনাই।গীরাহ বোধের

গল্প।

একবার কি হয়েছে শুনো,অাম্মাজান অায়শার ঘরে

রসূলুল্লাহ অার তার সাহাবারা খেতে বসেছেন।এমন সময়

উম্মে সালামাহ অাম্মাজান তার রান্না করা খাদ্যে

পূর্ণ প্লেট পাঠালেন,তখন কি হয়েছে শুনো,অাম্মাজান

অায়শা খুব ঈর্ষাকাতর হয়ে ওই প্লেটটাকে এক বাড়িতে

ভেঙে ফেললেন।হাহা!কি বাচ্চামো তাইনা?এটাও কিন্তু

এক প্রকার গীরাহ বোধ।অাচ্ছা তুমি জানো গীরাহ মানে

কি?গীরাহ হলো একধরণের ঈর্ষা,প্রোটেক্টিভ

জেলাসি..........

অামি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।তিনি অামার একহাত ধরে

শুয়ে অাছে।অার অামি উনাকে মেনে নিতে পারছিনা।

নাবিলা রহস্য না জানা অবধি অামার শান্তি মিলবেনা

হয়তো।মানুষটা মাসনুন অামল করা শুরু করেছেন।অামায়

মুখে মুখে অায়াতুল কুরসী,তিনকুল,সূরা বাকারার ২৮৫-২৮৬

অায়াত পড়াচ্ছেন।অামি পলকবিহীন চোখে তাকিয়ে

অাছি তার দিকে।এই মানুষটাকে এত স্বচ্ছ, এত পবিত্র

মনে হয়,তাহলে তিনি নাবিলা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন

কেন বারবার!!

ইনশাআল্লাহ চলবে.......






"শায়খ"

পর্ব পাঁচ........

সারাটা রাত অামার কতটা অস্বস্তিতে

কাটছিল,বোঝানো সম্ভব নয়।মাথায় হাজারো চিন্তা জট

পাকিয়ে যাচ্ছিল।শেষে অার সহ্য করতে না পেরে উঠে

সাজদায় পরে গেলাম।যত অভিযোগ,সন্দেহ ছিল,সব

রব্বকে জানিয়ে উপায় খুঁজছিলাম।স্বলাত শেষে সূরা

ইনশিরাহ পড়লাম অনেকক্ষণ ধরে।স্বস্তি না মিললেও বুক

থেকে ভারী বোঝা নেমে গেছে,এটা অন্তত বুঝেছি।

পানি খাওয়ার জন্য টেবিলের কাছে অাসতেই দেখি

শায়খের ফোন!ধরবোনা ধরবোনা করেও ফোনটা হাতের

মুঠোয় পুরে নিলাম।কোনও পাসওয়ার্ড,পিন,লক না থাকায়

ফোনলক খুলতে অামায় বেগ পেতে হয়নি।গ্যালারি,ই

নবক্স,কললিষ্ট,ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জ

ার,ইমো,হোয়াটসঅাপ...........

কোনও কিছুই চেক করা বাকি রাখিনি। কিচ্ছু নেই!

বিশ্বাস করুন,একদম কিচ্ছু নেই।উনাকে সন্দেহ করার মতন

একদমই কিচ্ছু পাইনি ফোনে।হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে

দেওয়া মাত্রই অাবার বিদ্যুৎ গতিতে ফোনটা হাতে

নিলাম।সব চেক করেছি,কিন্তু কন্টাক্ট লিস্ট তো চেক

করিনি!! কাঁপা কাঁপা হাতে কন্টাক্ট লিস্টে ক্লিক

করলাম।সবগুলো সেভ করা নাম্বার দেখছিলাম।হটাৎ

চোখ অাটকে গেলো,একটা নাম্বারে......

'দুহার অাম্মু' দিয়ে সেভ করা নাম্বার টা।দুহা কে অামি

জানিনা।দুহার অাম্মু কে তাও জানিনা।কিন্তু এখনই যদি

জানতে না পারি,তাহলে এই সন্দেহটা অামায় কুঁড়ে কুঁড়ে

খাবে।রুম থেকে বেরিয়ে এসে ওই নাম্বারে ডায়াল

করলাম।একবার...দ

ুইবার...তিনবার......

বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর,অনেকটা ঘুমে জড়ানো

কিন্তু উত্তেজিত নারী কণ্ঠ ওপাশ থেকে কোনও সূচনা

ছাড়াই বলে উঠলো.......

'বাহ!বাহ!মোল্লা সাহেবের তাহলে মনে পড়েছে

অামাকে.....

অামি জানতাম,যতই মোল্লাগিরি দেখাও,তুমি অামায়

ছাড়া অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে

পারবেনা।তো মোল্লাসাহেবের কি খবর?কালকের

রাতটা কেমন কাটলো?'

একেকটা কথা অামায় তীরের মতন বিদ্ধ করছিল।কিছু

বলার বা শোনার সাহস হয়নি অামার অার।লাইনটা কেটে

দিয়ে ফোনটা অাবার অাগের জায়গায় রেখে দিলাম।

কোনওমতে টলতে টলতে জায়নামাজে ফিরে এসেছি

অামি।বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই যদি কোনও মেয়েকে

জানতে হয়,তার স্বামীর প্রতি অন্য একটা মেয়ের এমন

উক্তি,তাহলে ওই মেয়েটার হালত কেমন হওয়া উচিত!!

অামার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল।দাঁতে

দাঁত চেপে কান্না চাপার অপ্রতিরোধ্য চেষ্টা করা

সত্ত্বেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম।অামার

গোঙানিতে,নাকি উনার অভ্যাসবশত বলতে

পারিনা,হটাৎই উনার ঘুম ভেঙে গেল।খুব শব্দ করে পড়ে

উঠলেন,

"অালহামদুলিল্লা হিল্লাযি অাহ ইয়ানা বা'দামা

অামাতানা,ওয়া ইলাইহিন নুশুর"

বিছানা থেকে উঠে অামার কাছে এসে,সালাম দিয়ে

কয়েকবার কান্নার কারণ জানতে চাইলেন।অামার

অবস্থা এমন ছিলো যে,তাকে দেখামাত্র কান্নার বেগ

অারও বেড়ে যাচ্ছিল।তিনি অামাকে যতবার স্পর্শ

করছিলেন,অামি ততবার তাকে সরিয়ে দিচ্ছিলাম।

অাসলে অামার তার প্রতি এই দুইদিনে যত শ্রদ্ধা

জেগেছিল,সব এখন ঘেন্না অার বিদ্রুপে পরিণত হয়ে

গেছে।তাকেও অন্য পাঁচজন লেবাসধারী মুসলিমের মতনই

মনে হচ্ছে,যারা মুমিন হওয়ার নাটক করে।রাগে,ঘেন্নায়

উনার পাশ থেকে উঠে পরি।উযু করে এসে অাবারও

স্বলাতে দাঁড়াই,সাজদায় গিয়ে অামি অাগে কখনও

বাংলায় দুঅা করিনি,কিন্তু সেদিন করেছিলাম।খুব করে

অাল্লাহকে বলেছিলাম অামার দুঃখের ভার কমিয়ে

দিতে,অামায় পথ দেখাতে।

সাজদাহ থেকে যখন উঠেছিলাম,অামার মনে হচ্ছিল,সব

কষ্ট শেষ।কান্না অাটকে রাখলে গলায় যে চাপা

ব্যাথাটা হয়,সেটা অার নেই,অশ্রুও অার গড়াচ্ছে

না,একদম হালকা লাগছে নিজেকে।সালাম ফিরিয়ে

অামি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম।উনি

অামার জায়নামাজের পাশেই বসে ছিলেন।অামাকে

উনার দিকে তাকাতে দেখে অাবারও এগিয়ে এলেন।বলা

শুরু করলেন,

--তোমার অাসলে কি হয়েছে বলো তো?এমনভাবে

কাঁদছো কেন তুমি?তুমি কাঁদলে অামার খারাপ লাগে।কি

হয়েছে বলো?বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে?অামি

কোনওভাবে তোমায় কষ্ট দিয়েছি?অামার পরিবার

তোমাকে অাপন করে নিচ্ছেনা বলে কষ্ট পাচ্ছ?ও

অামিনা!চুপ কেন তুমি? কিছু তো বলো!প্লিজ......

কিছু একটা বলো!

অামি স্থির কণ্ঠে বললাম,

"দুহার অাম্মু ই কি নাবিলা?"

এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অামায়

স্পর্শ করতে গিয়েও করেন নি অার।বিস্ফারিত চোখে

তাকিয়ে ছিলেন।উনার এই কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থা

দেখে অামি অাবারও প্রশ্ন করলাম....

--অাহলিয়া হিসেবে কি অামি অাপনার কাছ থেকে এই

প্রশ্নের উত্তর জানতে পারিনা?অাপনি অামার

অলঙ্কার,ঠিক একই ভাবে অামিও তো অাপনার অলঙ্কার।

তাহলে অাপনার অামার মাঝে রাখঢাক কেন থাকবে?কি

লুকাচ্ছেন অাপনি অামার থেকে?

প্রশ্ন গুলো করার সাথে সাথেই তিনি ডুকরে কেঁদে

উঠলেন।অামার কাছে খুব কাকুতিভরা কণ্ঠে জানতে

চাইলেন,

--এসব না জানলে কি হয়না অামিনা?

--সবটুকু না জানলে অামি স্বস্তি পাচ্ছিনা জনাব।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম।

--অামিনা!ও অামিনা!তুমি কি জানো না,পাপ প্রকাশ

করা গুনাহ?অামি এমনিতেই অনেক গুনাহগার,পাপ প্রকাশ

করতে বাধ্য করে অামার গুনাহ অার নাইবা বাড়ালে.....

--অামি কিচ্ছু জানিনা,জানতে চাইওনা।অামি শুধু

নাবিলা অার দুহার অাম্মুর ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি।

তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে অামার কাছ থেকে জানতে

চাইলেন অামি দুহার অাম্মু,অার নাবিলার কথা কার কাছ

থেকে জানতে পেরেছি।

অামি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জায়গা থেকে উঠে টেবিলের

উপর থেকে তাকে তার ফোনটা এনে দিলাম।হাঁটার সময়

খেয়াল করলাম অামি এখন অার টলছি না।কষ্টের অনুভূতি

ও কমে গেছে।এতক্ষণ যে উত্তাল সমুদ্র বহমান ছিল

অামার মাঝে,তা এখন একেবারেই শান্ত হয়ে গেছে।

অামি ফোন এনে উনার হাতে দিতেই দেখতে

পেলাম,প্রায় ত্রিশটি মিসড কল,সবগুলোই দুহার অাম্মু

দিয়েছে।এটুকু দেখেই তিনি একপ্রকার অার্তনাদ করে

বললেন,

--এ কি করেছ অামিনা!এ কি করলে তুমি!!তুমি কি

জানোনা, কারও দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান নিয়ে কতবার

নিষেধাজ্ঞা এসেছে?তুমি জানোনা,সূরা হুজুরাতে স্পষ্ট

বলা হয়েছে,কারও গোপন বিষয় অনুসন্ধান না করতে?তবুও

তুমি এটা কেন করলে?

--অামি জানিনা এত কিছু।অাপনি অাগে অামার প্রশ্নের

উত্তর দিন।

--তুমি কি জানোনা,বিয়ের অাগে কৃত গুনাহ, বিয়ের পর

প্রকাশ করা উচিৎ নয়।অামিনা!কেন জেদ করছো?যা কিছু

কল্যানকর নয়,তা তুমি নাইবা জানলে....

--অামি না জানলে শান্তি পাবনা জনাব।সন্দেহ খুব

খারাপ,খুবই ভয়ানক!

--বেশ!তাহলে শুনো,নাবিলা ছিল অামার ব্যভিচারের

সঙ্গী।অাঠার বছর বয়স থেকে একুশ বছর বয়স পর্যন্ত অামি

শায়ত্বানের ধোঁকায় তার সাথে ব্যভিচারে মগ্ন ছিলাম।

যিনাহয় মগ্ন ছিলাম।

অামিনা!যখন অামি হিদায়াত পেলাম,বুঝতে

পারলাম,এটা কত বড় গুনাহ,অামি বারবার তাকে বিয়ে

করতে চেয়েছি।অামি জানিনা কেন,কোন কারণে সে

অার অামায় বিয়ে করতে রাজি ছিলনা।তবে অামি

চেয়েছিলাম তাকে বিয়ে করতে,পাপ হতে মুক্তি পেতে।

--যিনাহয় মত্ত ছিলেন মানে!অাপনাদের কি শারীরিক......

--না অামিনা,না!

অামার মুখের কথা টেনে নিয়েই বললেন তিনি।

তুমি জানোনা অামিনা,অামি তার কাছে অক্ষম একটা

মানুষ।তার হাত ধরা ব্যতিত তার অার কাছে যাইনি বলে

সে অামায় প্রচুর অবজ্ঞা করতো,নপুংসক বলতেও দ্বীধা

করতো না।কিন্তু অামি অামার চিন্তায় অটল থাকতাম।

যিনাহয় মত্ত থাকার মানে কেবলমাত্র শারীরিক

বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া,তা তোমায় কে বললো?তুমি কি

চোখের যিনাহ,হাতের যিনাহ,পায়ের যিনাহ,জিহ্বার

যিনাহ সম্পর্কে ভুলে যাচ্ছ?যেখানে অাকৃষ্ট হওয়ার

অাশংকা থাকলে ওযর ছাড়া গায়রে মাহরামের সাথে

কথা বলা ই জায়েজ না,সেখানে একজনের সাথে অামি

'প্রেম' নামক হারাম সম্পর্কে মগ্ন!এটা কি যিনাহ নয়

অামিনা?লজ্জাস্থান তো কেবলমাত্র যিনাহকে

পরিপূর্ণতা দেয় অামিনা!!হারাম কিছুতে

দৃষ্টিপাত,কথাবা

র্তা,কাজকর্ম সবই হারাম।

--অাপনি এত ধার্মিক হয়েও এসবে জড়ালেন কিভাবে!?!

--বিশ্বাস করো অামিনা,অামি তখন নামমাত্র মুসলিম

ছিলাম।অামার পরিবারের দিকে তাকালেই তুমি বুঝতে

পারবে।অামি শুধু জানতাম,বিয়ের অাগের প্রেমে

অশ্লীলতা না থাকলে তা জায়েজ।অামি জানতাম

কেবলমাত্র ফিজিক্যাল রিলেশনশীপই যিনাহ।বাদবাকি

হাত ধরা,চুমু,কিংবা জড়িয়ে ধরা যা কিছুই হোক না

কেন,তা জায়েজ।অামি জানতাম,কথা বার্তা

হয়না,দেখা হয়না,তবুও দূর থেকে ভালবাসলে তা জায়েজ।

এটাও যে মনের যিনাহ,তা অামি জানতাম না

অাহলিয়া......

--অার দুহার অাম্মু?সে কে?

--অামার স্বপ্ন ছিলো অামাদের মেয়ের নাম দুহা হবে।

সেইজন্যই নাবিলার নাম দুহার অাম্মু দিয়ে সেভ

করেছিলাম।

--বুঝলাম।

--অামিনা!বিশ্বাস করো অামিনা!

অামি জানতাম না যিনাহর শাস্তি এত ভয়াবহ

যে,অবিবাহিত যুবক যুবতী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার

ইহকালীন শাস্তি হিসেবে দুজনকেই ১০০ বেত্রাঘাত

করতে হবে এবং সাথে একবছরের জন্য বহিষ্কার হতে

পারে সমাজ হতে।অামি জানতাম না,ব্যভিচারীদের

সাথে অাল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না,অামি

জানতাম না,ব্যভিচারীরা উলংগ অবস্থায় এমন এক চুলার

মধ্যে থাকবে যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর

নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত

থাকবে তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে

মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি

অবস্থায় পৌছে যাবে; অত:পর আগুন যখন স্তমিত হয়ে

যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের

সাথে এই আচারণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে.........

অামি খুবই লজ্জিত অামার এই পাপের জন্য,অামি সবসময়

অাল্লাহর কাছ থেকে এই গুনাহ থেকে মাফ চাই

অামিনা.....

এখনও চাই।অামিনা,এটা তো তোমার হক্ব ছিলো,যা

যিনাহর দ্বারা অামি নষ্ট করেছি।এই অামিনা!তুমি

অামায় মাফ করবে তো?অামিনা!!চুপ করে থেকো না।

অন্তত একটা অাশার বাণী শোনাও।

মানুষটা কাঁদছেন।উনার চাপা কান্না অামার হৃদয়ে

অন্তঃদহন ঘটাচ্ছে।অামি ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত

রেখে বললাম,

--চলুন,তাহাজ্জুদের সময় শেষ হয়ে অাসছে।তাহাজ্জুদ

পড়বেন চলুন।

--অামার উপর এখনও রাগ করে অাছ তুমি?অামায় মাফ

করবে না?

--তাওবাহ করলে তো স্বয়ং অাল্লাহই মাফ করবেন।

অামার রব্ব যখন তাওবাকারীকে মাফ করে দেন,তখন তার

বান্দা হয়ে তাওবাকারীর উপর ক্ষোভ রাখার মতন এতটাও

দুঃসাহস অামার নেই শায়খ!!

প্রথমবারের মতন তাকে অামি শায়খ বলে ডাকলাম।

অামার ডাক শুনে,নাকি অামার উত্তর শুনে জানিনা,উনি

অামায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন।

কাঁদছেন উনি,কাঁদছি অামিও.........

কিসের কান্না কে জানে...............

হটাৎ ফিসফিসিয়ে উনি অামায় বলে উঠলেন,

--সো মাই ডিয়ার অাহলিয়া,ডু ইউ নিড মোর টাইম?

--নো ডিয়ার,নিদার টাইম,নর স্পেস............

লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে উত্তর দিলাম।মাত্র দুদিনের

সম্পর্কে এতটা সহজ হয়ে কিভাবে তার সাথে কথা

বলছিলাম কে জানে।খুব প্রশান্তি লাগছিলো।মুখ ফুটে

অজান্তেই বের হয়ে এলো,

অালহামদুলিল্লাহ..............!!

ইনশাআল্লাহ চলবে.........





"শায়খ"

পর্ব ছয়.....

ফজরের পর তার মুখে মুখে অার রহমান পড়লাম।

--অার রহমান......

অাল্লামাল ক্বুরঅান....

খলাক্বল ইনসান.......

অাল্লামাহুল বায়ান........

...................................

...................................

...................................

রব্বুল মাশরি ক্বয়নি ওয়া রব্বু্ল মাগরিবাইন........

ফাবি অাইয়্যি অালা ই রব্বি কুমা তুকাজ্জিবান.......

...............................

...............................

ফা ইজান সাক্ক্বতিস সামাউ ফাকানাতান ওয়ার দাতান

কাদ্দিহান.........

...............................

................................

হাজিহি জাহান্নামুল লাতি ইউকাযযিবু বিহাল

মুজরিমুন.......

.............................

ওয়া লিমান খফা মাক্বমা রব্বিহি জান্নাতান...........

..............................

..............................

তাবারকাসমু রব্বিকা যিল যালালি ওয়াল ইকরম.........

...............................

..............................

--অামিনা!এই সূরাটা খুব সুন্দর না?মুখস্থ করতে কি খুব

বেশী সময় লাগবে তোমার?

--না,কারণ এখানে একই অায়াত কয়েকবার অাছে।

--হ্যাঁ,পাশাপাশি অারও একটা কারণ অাছে।এই সূরাটার

অর্থ এতই মনকাড়া যে তুমি একবার পড়লেই মনে থাকবে

ইনশাআল্লাহ!অর্থটা তুমি পড়ে নিও,অামি হালকা ধারণা

দিই কেমন?

দেখো এই সূরার প্রথম অায়তটা কিন্তু তোমার অামার

রব্বের নাম দিয়ে শুরু হয়েছে,তাইনা?এই নামের মাহাত্ম্য

বলে প্রকাশ করা যাবেনা।এই,তুমি রহমান অর্থ জানো?

--হ্যাঁ,পরম করুণাময়।

--কারেক্ট!এই সূরার মজা এটা ই.....

দেখো সূরার প্রথমে রব্বের একটা বিশেষণ এর কথা

উল্লেখ অাছে,যে তিনি পরম করুণাময়।তারপরই তার করুণা

সম্পর্কে উদাহরণ দিয়েছেন তিনি।

--যেমন?

--এইযে কুরঅানের সৃষ্টি,মাখলুকাতের সৃষ্টি,ভাষা

শিক্ষা দেওয়া,প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা অর্থাৎ এইযে

চাঁদ সূর্য নিজের কক্ষপথে বিরাজমান,মানুষ অার জিনকে

সৃষ্টির উপমা,সমুদ্রের প্রবাহ,মনিমুক্তা সৃষ্টি,সমুদ্রের

জাহাজ,দুনিয়ার সব কিছু.......

সবকিছু তো তিনিই সৃষ্টি করেছেন তাইনা?এসবই উল্লেখ

করেছেন।

--তারপর?

--তারপর শুনোনা,তোমাকে অামাকে তিনি হিসাব

নিকাশের রিমাইন্ডার দিয়েছেন।রিমাইন্ডার দিয়েছেন

কিয়ামতের..........

জানো,সেদিন অপরাধীকে কিভাবে চেনা যাবে?

--কিভাবে?

--চিহ্নের সাহায্যে।এখানে অাবার জান্নাত

জাহান্নামের বর্ণনা দেওয়া অাছে।যেমন জাহান্নামের

ফুটন্ত পানি,জান্নাতের ঝর্ণাধারা,বাগান

,ফলগাছ,হীরা,প্রবাল,ফলমুল,ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুর........

--হুর?!

--হু,ডাগর চক্ষু বিশিষ্টা হুর!যাদেরকে এর অাগে কেউ

কখনও স্পর্শ করেনি।অার তারা......

--অাপনি জান্নাতে গেলে অাপনাকেও কি হুর দেওয়া

হবে?

--কেন শুনি?গীরাহ বোধ নাকি?

--অামি পড়েছিলাম,একজন জান্নাতি পুরুষকে বাহাত্তর

টা করে হুর দেওয়া হবে।অাপনি জান্নাতে গেলে

অাপনাকেও দেওয়া হবে,তাইনা?তখন কি অাপনি হুর

নিবেন?

--বাহাত্তর টা হুর!!!এই কথা তোমাকে কে বলেছে শুনি!!

কুরআন বা কোন সহীহ হাদীসের কোথাও লেখা নেই যে

প্রতিটি পুরুষ জান্নাতে বাহাত্তর টি হুর পাবে ৷বরং

যেসকল পুরুষ প্রথম বেহেস্তে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন

করবে, তাদের ব্যাপারে রাসূল সাঃ বলেছেন, যে দলটি

সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেই দলের মানুষদের

আকৃতি হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল। তারা

সেখানে থুথু ফেলবে না, নাকের শিকনিও বের হবে না,

প্রস্ৰাব-পায়খানাও করবে না। তাদের ব্যবহার্য পাত্রসমূহ

হবে স্বর্ণের তৈরি আর সোনা-রুপার সংমিশ্রণে তৈরি

হবে চিরুনি। চন্দন কাঠ ও আগরবাতি জ্বালানো থাকবে।

তাদের শরীরের ঘাম হবে মিশকের মতো সুগন্ধময়। তাদের

প্রত্যেকের জন্য দুজন করে স্ত্রী (হুর) থাকবে। সৌন্দর্যের

কারণে গোশতের ভিতর দিয়ে তাদের পায়ের হাড়ের

মজ্জা পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হবে। তাদের মধ্যে না থাকবে

ঝগড়া-বিবাদ, আর না থাকবে হিংসা-বিদ্বেষ। তাদের

সকলের অন্তর যেন একটি অন্তরে পরিণত হবে। সকাল-

বিকাল তারা আল্লাহ তা'আলার পবিত্রতা বর্ণনা করবে।

--তাহলে যে অামি এতদিন পড়লাম.......!

--ভুল পড়েছ হয়ত।এটা সহীহ বুখারী,অার মুসলিম দুইটাতেই

অাছে।

--অাচ্ছা,দুইটা দিলে দুইটা হুর কি নিবেন?

--অামার ঈমান,অামল খুবই দূর্বল অামিনা,অামি এসব

নিয়ে ভাবিনা।

--শুনুন,হুর নিলে কিন্তু অামাকে পাবেন না।

--পাব না মানে?

হতবাক হয়ে বললেন উনি।

পাবনা কেন?জান্নাতে গেলে তুমিই তো অামার স্ত্রী

হবে।

--তবুও,অামি সতীন মানতে পারবনা।

মন খারাপ করে বললাম......!

অামার কথার ঢংয়ে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন।

--ও অামিনা!তুমি জানো,জান্নাতি নারীর তূলনায় হুর

কিছুই না।জান্নাতি নারীর সৌন্দর্য,সম্মান হুরের থেকে

অনেক বেশী।

--হোক বেশী,লাগবেনা হুর।অামি সাবধান করে

দিচ্ছি,অাপনি কিন্তু একটা হুরও নিবেন না।

--তুমি অামায় জান্নাতি সার্টিফিকেট দিয়ে ফেলছো

অামিনা।

হতাশার স্বরে বললেন তিনি।

জানো অান নাজমে কি বলা হয়েছে,

'ফালা তুজাক্কু অানফুসাকুম,হুয়া অা'লামু বিমানিত

তাক্ব....'

--অর্থাৎ?

--অর্থাৎ তোমরা নিজেদেরকে খুব পবিত্র মনে করো না।

কে তাক্বওয়া অবলম্বন করে তা তিনি ভালভাবেই

জানেন।

--অাস্তাগফিরুল্ল--অাস্তাগফিরুল্লাহ,বুঝলাম এখন।

--অামিনা!তুমি শুদ্ধভাবে কুরঅান পড়তে পারো?অাজ

দেখলাম জিম,যাল,যা এ একই উচ্চারণ করলে,উচ্চারণ তো

একই না।

--না,অাসলে.......

মানে.....

--বুঝেছি,বলতে হবেনা।মাত্র ছয়টা বাজে,এসো,খাতা

কলম নিয়ে বসি।অাজ অামরা তাজউইদ নিয়ে পড়ব

ইনশাআল্লাহ।

--এখন?!মানে....

এখন তো সকাল হয়ে গেছে।বাসায় কাজ করতে হবে না?

--হ্যাঁ,ভাল কথা মনে করেছ।শুনো অামিনা,তোমায় কিছু

টিপ্স দিই।প্রথমেই নিয়ত করে ফেলো,যা কিছুই হোক না

কেন,মায়ের মন জয় করবে ই।তারপর শুনো..............

তিনি একের পর এক উপায় বলে দিচ্ছেন,কিভাবে এগোতে

হবে।অামি মুগ্ধতার সাথে মুচকি হাসছি।সব শায়খই যদি

অাহলিয়াকে এভাবে সহযোগীতা করে,তাহলে জীবনটা

কোথাও গিয়ে অাটকে থাকার কথা না।

চলবে ইনশাআল্লাহ.....





"শায়খ"

পর্ব সাত.....

শাশুড়ির মন জেতার যথেষ্ট টিপস দেওয়ার পর শায়খ ঝাড়ু

নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে গেলেন।অামার তো চক্ষুচড়ক

অবস্থা!!তিনি নাকি ঘর ঝাড়ু দিবেন!!এটা তো অামার

কাজ!!!!অামি তার হাত থেকে ঝাড়ু নিতে গেলেই তিনি

চওড়া হাসি দিয়ে বললেন,

"ঘরের কাজে অাহলিয়াকে সাহায্য করা সুন্নাহ তো।তুমি

এক কাজ করো,দেখো তো তাকে ডিম থাকার কথা,ডিম

অাছে কিনা।অার দেখো চালের গুড়া অাছে কিনা,কাঁচা

মরিচও

অাছে মনে হয়।তুমি বরং এক কাজ করো,নাস্তা বানানোর

মতন কি কি অাছে দেখ।অামি অাসছি"

অামি উনার কথামত সব খুঁজে বের করতে করতেই উনি চলে

এসেছেন।অামার হাতে হাতে সাহায্য করলেন নাস্তা

বানাতে।বানানোর পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

--অামিনা!অাম্মা ফজর পড়েই অাবার ঘুমান।উঠেন

সাতটার পর,বাড়ির সবাই একই সময়ে উঠে।তুমি একটা

কাজ করো,নিকাব পড়ে নাও,তারপর চলো নাস্তা নিয়ে

অামরা ওই ঘরে যাই!

--অাচ্ছা,এই অালাদা ঘরের কি দরকার ছিল?

--ছিল বৈকি!এটা তোমার হক্ব তো।কয়েকদিন একটু কষ্ট

হবে।তারপরই ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।সবর করো

অামিনা!

নাস্তা নিয়ে ওই ঘরে যখন গেলাম,তখনও শাশুড়ি মা উঠেন

নি।তিনি অামায় নিয়ে টেবিলে খানা সজালেন।মাকে

ডেকে তুললেন।মা অামার সামনে অাসা মাত্র অামি

সালাম দিলাম।অার উনি উত্তর না দিয়েই বলে উঠলেন,

--তুমি এখানে কেন এসেছ?অামার সংসার ভেঙে শান্তি

পাওনি?ঘর অালাদা করে শান্তি পাওনি?হাড়ি অালাদা

করে শান্তি পাওনি?এখন এগুলো এনে ভালমানুষী

দেখাচ্ছো?চেনা অাছে তোমার মত......

--ও অাম্মা!তুমি রাগ করে অাছ এখনও?

শাশুড়ি মায়ের কথার মাঝখানে বলে উঠলেন শায়খ.....

অামিনা,জানো!অাম্মার খুব পছন্দের খানা হলো

নেহারি অার চালের গুড়ার রুটি।অামি অাজকে ফেরার

সময় গরুর পায়া নিয়ে অাসব ইনশাআল্লাহ!ও মা!নাকি

খাসীর পায়া অানতাম?

--কুত্তার পায়া চিনিস?ওইটা এনে তোর বউকে খাওয়া।

অামার সামনে এসব নেকামি করবি না।ভাল সাজতে হবে

না।

এটা বলেই মা উনার রুমের দিকে যাচ্ছিলেন।

অামার শায়খ উনার পা জড়িয়ে ধরে ফেললেন।

--ও মা!তুমি এখনও রাগ করে অাছ?তোমার ছেলের উপর

রাগ করে অাছ গো মা?অামি নাহয় ভুল করেছি,এই

মেয়েটা কি করেছে বলো?ও তো জানতো না,অামি

অালাদা ঘর করছি ওর জন্য।অার ওকে দেখতে গিয়ে তো

তুমিই বলেছিলে,ওকে দেখতে মায়া লাগে খুব।এখন ওকে

এভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো কেন?ওর তো দোষ নেই।

--পা ছাড় অামার।ও ই দায়ী,অামার সংসারের ভাঙনের

জন্য ও ই দায়ী।তখন বলেছিলাম ওকে দেখতে মায়া

লাগে।এখন বলি শুন,এরকম কালো মেয়ে অামি অাগে

কখনও দেখিনাই।গায়ের রংটা কেমন ময়লা।অামার ওকে

পছন্দ না।দেখি পা ছাড়।এসব নাটক করিস না।

--ইন্নালিল্লাহ!মা!এসব কি বলো?তুমি তো এমন ভাবে

কথা বলো না।অামার উপর রাগ বলে তুমি অাল্লাহর

সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করবে? ও মা! তুমি অামার উপর এখনও

অসন্তুষ্ট? তাহলে দুঅা করো অামি যাতে অাজ রাস্তায়

বের হলে এক্সিডেন্ট করে বসি।জানো তো,মায়ের দুঅা

বিদ্যুৎ গতিতে অাল্লাহর কাছে পৌঁছে।দুঅা করো যাতে

অামি মরি....

--চুপ কর বেয়াদব!তোর মরার জন্য তোকে জন্ম

দিয়েছিলাম অামি?উঠ তুই,উঠ এখনই।

--অাগে বলো মাফ করে দিছ।

--তোকে মাফ করলেও ওই মেয়েকে মাফ করবোনা অামি।

ওর জন্য অামার ছেলে অালাদা হয়ে.....

কান্নায় কথা অাটকে গেলো মায়ের।মা কাঁদছেন।অামার

শায়খও কাঁদছেন।অামার শায়খ খুব অাহ্লাদ করে মায়ের

হাতে খেতে চাচ্ছেন।মা কড়া ভাবে বলে দিয়েছেন,

অামার তৈরি করা নাস্তা খাবেন না।তবুও অামার

শায়খের অাবদারের কাছে হেরে গিয়ে উনাক খাইয়ে

দিচ্ছেন মা।অামার শায়খ অামার হাত ধরে পাশে

বসালেন মায়ের হাতে খাওয়ানোর জন্য।বিড়বিড় করে

কিসব বলার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অামাকে মা খাইয়ে

দিয়েছেন।অামি হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম।কি করা উচিৎ

বুঝছিলাম না।এমন সময় বড় জা এসে টিপ্পনী

কাটছিলো.....

--ওমা!অাপনি এর হাতের রান্না খেলেন?গতকাল কত

বেলা করে গিয়ে দেখি ও নাপাক মেয়ে,গোসল টুকুও

করেনি।অাজ ও করেনি মনে হয়।এই অশূচী মেয়ের হাতের

খাবার খেলেন অাপনি?

শায়খকে দেখলাম প্রশস্ত হাসি হেসে মায়ের দিকে

তাকিয়ে বলছেন,

--অার বলিও না মা,ওকে এসব তো শেখাতে হবে তাইনা?

এটা তো অামিনার প্রথম বিয়ে, তাই কি করা উচিৎ

বুঝেনা ও।অাজকে কি হয়েছে শুনবে?অাজকে ও.....

--এই ছেলে!তোর মাথা খারাপ?প্রথম বিয়ে মানে কি?

মেয়েদের কি দশ বারোটা বিয়ে হয় নাকি?ও মেয়ে

জানেনা,তো অামাকে জিজ্ঞাস করবে না?শেখার

অাগ্রহ না থাকলে অামি কিভাবে শেখাব?অামি কি

যেঁচে গিয়ে শেখাব নাকি?

অামার ঠেকা,হুহ!

--এই জন্যই তো কালকে তোমাকে ওই ঘরে যেতে

বললাম।তুমি রাগ করে যাওনি।তুমি না শেখালে ও শিখবে

কার থেকে বলো তো?তোমার চেয়ে ভাল শিক্ষিকা এই

দুনিয়ায় অাছে নাকি অার?

অামি বুঝতে পারছিলাম,শায়খ এসব কথা মায়ের মন নরম

করার জন্য বলছেন।তাই অামার অজান্তেই অামার মুখে

হাসি ফুটে উঠেছিল।অাচমকা শাশুড়ি মা অামার দিকে

তাকিয়ে বলে উঠলেন,

--রান্না বান্না কিছু পারো?নাকি সেটাও শেখাতে হবে?

--অল্প একটু পারি,অাসলে.....

--দেখি রান্নাঘরে যাও,ফ্রিজে ডিম অাছে।ভেজে

অানো,যাও।

অামি অাবারও গাধার মত বসে অাছি।রান্নাঘর

কোথায়,ফ্রিজ কোথায়,কিছুই তো জানিনা অামি।

অামতা অামতা করে জিজ্ঞেস করলাম,

--অামি তো রান্নাঘর চিনিনা....কোনদিক দিয়ে......

--হয়েছে অার বলা লাগবেনা।রূপা,যাও তো ওকে

রান্নাঘরে নিয়ে যাও।রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়েই চলে

অাসবে।অার দেখি তো তোমার হাতে ফোন অাছে

কিনা।এখন তো মেয়েরা ইউটিউব থেকে দেখে সব রান্না

করে।দেখি হাত দেখাও.......

রূপা অামার বড় জায়ের নাম।ডিম ভাজার সময় অামি

ইচ্ছে করেই নুন দিইনি,শায়খ বলেছিলেন এমন একটা ভাব

করতে যাতে মনে হয় অামি একদমই অানাড়ি।এতে দুইটা

লাভ,

এক.মা বুঝতে পারবেন,তাকে ছাড়া সংসার অচল।

দুই.মা রান্না শেখাবেন।এতে রান্না শেখার বাহানায়

মায়ের কাছে বেশীক্ষণ থাকা যাবে।ফলে দূরত্ব ও কমে

যাবে তাড়াতাড়ি।

অামি শায়খের ট্রিকস ফলো করে ডিম ভেজে মাকে

দিলাম।মা একটুখানি মুখে দিয়েই বললেন,

--অাল্লাহ গো!এইটা কি ভেজেছে?নুন কোথায় নুন??ডিম

ও ভাজতে জানোনা?

--ভুলে গিয়েছিলাম মা,অামি অাবার করে অানছি।

কাতর কণ্ঠে বললাম।

--থাক থাক লাগবে না।তোমার দৌড় অামার বোঝা শেষ!

দেখলি বেটা,কাকে বিয়ে করে অানলি?ডিমও ভাজতে

পারেনা।

--তুমি শিখিয়ে দিও তো মা।অাসলেই দেখছি অামিনা

রান্নাটা পারে না।

--হ্যাঁ,হ্যাঁ!শিখাতে তো হবেই।ঠেকা অামার কিনা!না

শেখালে অামার ছেলেকে ডেইলি না খেয়ে,নুন ছাড়া

খানা খেয়ে থাকতে হবে।অাবার ঘরও অালাদা করেছে

তারা।অামাকে ছাড়া ঘর চলবে?এই মেয়ে,তুমি

তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।এখনই রান্নাঘরে ঢুকবে অামার

সাথে।

মা কড়া নির্দেশ দিয়ে নিজের রুমে গেলেন।অামি

শায়খের দিকে তাকানো মাত্রই তিনি অামায় চোখ

মারলেন।মুখে সেই প্রশান্তির হাসি.............

চলবে ইনশাআল্লাহ............




"শায়খ"

পর্ব অাট.....

প্রথম প্রথম অামি একদমই অানাড়ি ভাব নিয়ে শাশুড়ি

মায়ের কাছে রান্না শিখতাম।কত বকা যে

খেয়েছি,রান্নায় অানাড়ি বলে,তা বলার বাইরে।

প্রতিদিন নিয়ম করে রান্না করতাম মায়ের সাথে।

মাঝেমাঝে হাত পুড়ে যেত,অামি মাছ কাটতে পারতাম

না,প্রথম প্রথম কাটতে গেলে হাত কেটে যেত,অামার

শাশুড়ি মায়ের একটা অভ্যাস হলো,তরকারির যেই

অাইটেমই থাকুক না কেন,গোটা এলাচ ছাড়া রান্না

করলে মা মুখে তুলতে পারতেন না,মায়ের মনমতন করে

রান্না শিখছিলাম।বড় জা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে

চাকুরীরত ছিলেন,অামার শায়খ সকাল নয়টায় বের

হতেন,ফিরতেন রাত নয়টায়।অার দেওররা সকাল দশটা-

এগারোটার পর কেউ ঘরে থাকতো না বললেই চলে।পুরো

বাড়িতে অামি অার মা!তাই অনিচ্ছাবশত হলেও মাকে

অামার সাথে কথা বলতেই হতো।অামি প্রতিদিন বিকেল

বেলা মায়ের চুলে তেল লাগিয়ে দিতাম,বেণী করে

দিতাম।প্রথম প্রথম মা অবজ্ঞা করলেও,ধীরে ধীরে

তিনিও অামার সাথে ফ্রি হচ্ছিলেন।একদিন লাজ লজ্জা

একপাশে সরিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে চোখ নিচু

করে,লজ্জা লজ্জা ভাব এনে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

"মা!নাতী লাগবে?নাকি নাতনী?"

মা কিছুক্ষণ অামার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে

থেকে তেড়ে অাসলেন।অামার অাম্মাকে ফোন করে

একগাদা বিচার দিলেন অামার নামে।পরে অবশ্য নিজেই

হাসতে হাসতে বলেছিলেন,একটা নাতনী লাগবে উনার।

না না!নাতনী না,বোন লাগবে উনার।জিজ্ঞেস

করলেন,কবে দিতে পারব!

শুনে লজ্জায় অামার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।কোনোমতে

রুমে ফিরে শায়খের সাথে কপট রাগ দেখাচ্ছিলাম।অাস

লে এই প্ল্যানটা উনারই ছিলো তো!

ধীরে ধীরে মায়ের সাথে অামার দূরত্ব কমে অাসছিল।

তবে মায়ের মনে ক্ষোভ ছিল,অামাদের অালাদা ঘরের

জন্য।একদিন ইশার পর অামি শায়খকে জিজ্ঞেস

করেছিলাম, অাসলেই কি অালাদা ঘরের প্রয়োজন ছিল?

অামার শায়খ হেসে উত্তর দিলেন,

--এটা তোমার হক তো অামিনা।জানোই তো হাদিসে

অাছে দেওর ভাবির জন্য মৃত্যুর সমান।অার তোমার তো

একটাও ননদ নেই,সবাই ই দেওর,গায়রে মাহরাম।এদের

সাথে তো তোমার পরদা ফরজ, তাইনা?তোমার যাতে

পর্দার সমস্যা না হয়,ফ্রিলি মুভমেন্ট করতে পারো,

তাই ই অামায় অালাদা ঘর করতে হয়েছে।

--কিন্তু এতে লাভ কি?অামায় তো দিনের সিংহভাগ সময়

ই ওই ঘরে থাকতে হয়।যদিও পর্দা করি,কিন্তু অস্বস্তি

লাগে খুব!

--অাশা করা যায় খুব বেশীদিন তোমায় এই কষ্ট সহ্য করতে

হবেনা অামিনা!সবর করো......

--অাচ্ছা,অাপনাদের বাড়ির অাশেপাশে কোনও তালিম

হয়না,মহিলাদের নিয়ে?

--উঁ,বলতে পারছিনা।অাগামীকাল খোঁজ নিয়ে জানাব

ইনশাআল্লাহ!এখন অাসো তো,ঘুমানোর দুঅা পড়ি,জানো

না,রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও

ইশার পর বেশী রাত জাগাকে পছন্দ করতেন না?

--তা তো জানি।কিন্তু অাপনি মনে হয়,কিছু একটা ভুলে

যাচ্ছেন।

--ভুলে যাচ্ছি?!কি বলো তো!

--অাপনি কি ভুলে গেলেন,বুখারী শরীফে

অাছে,ঘুমানোর অাগে উযু করা সুন্নত?!অথচ অাজ অাপনি

উযু না করেই শুয়ে পড়েছেন!

--ইশ!একদম ভুলে গিয়েছিলাম।শুকরিয়া অামিনা,মনে

করিয়ে দেওয়ার জন্য,অামি এখনই অাসছি।

উযু করে এসে শায়খ দুই রাকাত নামায পড়লেন দেখলাম।

অামি তো অবাক হয়ে গেছি!কি অদ্ভুত!!একটু অাগেই না

তিনি মাসজিদ থেকে এলেন,অামার কোলে মাথা রেখে

কুরঅানও পড়লেন।এখন অাবার কিসের নামায!

উনি সালাম ফিরিয়ে উঠতেই উনাকে বললাম,

--এটা কিসের নামায ছিল!?

--এটা?এটা তো তাহিয়্যাতুল উযু ছিল।উযুর পর দুইরাকাত

নফল নামায পড়া।

--এটা কেন পড়লেন?মানে,এটার ফজিলত কি?

--এটা সুন্নাহ তো।রসূলুল্লাহ বলেছেন,'যে ব্যক্তি আমার

অজুর মতো অজু করে এমভাবে দুই রাকাআত নামাজ পড়বে

যে তার মনে কোন অন্য কোন ধারণা/কল্পনা জাগ্রত হবে

না বা মনে মনে অন্য কোন কথা চিন্তা করবে না তাহলে

তার পূর্বের সকল সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে'।

--কই!এতদিন তো এই নামায সম্পর্কে বলেন নি অাপনি।

মানে অাপনি জান্নাতে একা ই যেতে চান,তাইতো?

বুঝলাম।

অামি অভিমানের সাথে এটুকু বলে ওপাশ ফিরে

শুয়েছিলাম।তিনি অামায় টেনে তার কাছে অানলেন।

--এই যে অামিনা!শুনুন,অভ

িমান,অভিযোগ,রাগ,দুঃখ,কষ্ট সব স্বামীর বুকের মাঝে

এসে করবেন,বুঝলেন?এত

ে ভালবাসা বাড়বে।

--লাগবেনা ভালবাসা,যে অামাকে জান্নাতে নিতে

চায়না,তার জন্য কিসের ভালবাসা?ছাড়ুন অামাকে।

--না ছাড়লে কি করবে শুনি?সেদিনের মতন কুঁই কুঁই করে

বলবে,"অাই নিড সাম টাইম...."

বলে হেসে উঠলেন তিনি।প্রায়সময় ই সেদিনের এই

কথাটা বলে রাগান উনি অামাকে।অামি অাগে

রাগলেও,এখন অার রেগে যাইনা।নিজের বোকামির কথা

মনে পড়লে নিজের ই লজ্জা লাগে।

--অামিনা!একটা কথা বলবো,যদি কিছু মনে না করো.......

--ওমা!কি মনে করব অাবার?বলেন তো।

--না,অাসলে....

সেদিন দেখলাম গায়রে মাহরাম কয়েকজন তোমার

ফ্রেন্ডলিস্টে অাছে।পাশাপাশি তুমি উনাদের দাওয়াত

দিচ্ছো।এটা তো ঠিক না অামিনা!

--কেন?ঠিক না কেন? অামি তো বেহুদা অালাপ

করছিনা।দ্বীনের দাওয়াত ই দিচ্ছি,তাহলে সমস্যা

কোথায়?

--ও অামিনা!তুমি জানো,সূরা অাহযাবের বত্রিশ নং

অায়াতে তোমাকে অাদেশ করা হয়েছে,গায়রে

মাহরামের সাথে কথা বলায় কঠোরতা অবলম্বন করতে।

এতে করে তার তোমার প্রতি অাকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা

কমে যাবে।অার এটা তো জানো ই,দ্বীনের দাওয়াতে

কঠোরতা অবলম্বন করতে পারবে না।এর বিরুদ্ধে স্পষ্টত

নিষেধাজ্ঞা অাছে।

--কিন্তু....

--দাঁড়াও বুঝিয়ে বলি।দাওয়াত দেওয়ার নিয়ম

হচ্ছে,দায়ীকে অবশ্যই ই বিনয়ের সাথে,নম্রতার

সাথে,কোমল ভাবে দাওয়াত দিতে হবে।দ্বীনের

দাওয়াতের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই কঠোরতা অবলম্বন

করা যাবে না।পাশাপাশি নারীর উপর অাদেশ

অাছে,পরপুরুষের সাথে কথা বললেই কঠোরতা অবলম্বন

করতে হবে।তাহলে তুমিই বলো,একজন নারী একজন গায়রে

মাহরামকে কিভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিবে,যেখানে

তার উপর অাদেশ অাছে কঠোরতা অবলম্বন করার,অার

দাওয়াত দানের মূল শর্তই হলো কঠোরতা অবলম্বন না

করা?এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যাচ্ছে না?

--তা ঠিক,কিন্তু অামি তো সরাসরি বলছি না।

--জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অনলাইনের বিধানগুলো সম্পূর্ণ

অফলাইনের মতনই হবে গো অাহলিয়া।পাশাপাশ

ি দেখ,এটা ই শেষ নয়,গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলা

তখনই জায়েজ,যখন সেখানে ওযর থাকবে,পাশাপাশি

পরস্পর পরস্পরের উপর অাকৃষ্ট হওয়ার অাশংকা ও থাকবে

না।কিন্তু তুমি একটা বিষয় ভাবো,তুমি যখন গায়রে

মাহরাম কাউকে দাওয়াত দিবে,তখন সে কিন্তু

অাপনাতেই তোমার প্রতি মুগ্ধ হবে।বারবার ভাববে,

"অাল্লাহ!এই মেয়েটা এত জানে!!"

ব্যস!বদনজর লেগে যাবে।

--বদনজর?!অাপনি বদনজরে বিশ্বাস করেন?

--করব না কেন?এটা নিয়ে কত হাদিস অাছে জানো?এই

বদনজর একজন মানুষকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে

যে,কবর পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

--বুঝলাম,তারপর?

--এই দেখো,দ্বীনের লেবাসে শায়ত্বান হাজির!!জানোই

তো নারীর জন্য পুরুষ অার পুরুষের জন্য নারীর জন্য পুরুষের

চেয়ে বড় ফিতনা অার কিছু নেই।পাশাপাশি

দেখো,একজন নারী অার একজন পুরুষ নির্জনে থাকলে

সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শায়ত্বানের উপস্থিতি

থাকে।অার জানোই তো,শায়ত্বান অাদম সন্তানকে

পথভ্রষ্ট করার জন্য কত কু প্ররোচনা দেয়।এইজন্যই তো

দেখো না,বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণ,ভাই কর্তৃক বোন

ধর্ষণ,পরিবারের পুরুষ সদস্য,পাশের বাড়ির প্রতিবেশী

কর্তৃক সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এখন অহরহ হচ্ছে।

--কিন্তু অনলাইনে কি অামরা নির্জনে থাকছি নাকি?

--ইনবক্স!!ইনবক্স তো নির্জন স্থানই,তাইনা বলো?

--বুঝলাম এটা।কিন্তু একটা বাড়তি প্রশ্ন,সেদিন অামি

একটা ফাতওয়া পড়েছিলাম,নারীর কণ্ঠস্বর পর্দার

অন্তর্ভুক্ত নয়,তাহলে.....?

--হু,যথার্থ পড়েছ। নারীর কণ্ঠস্বর পর্দার অন্তর্গত নয়।

কিন্তু খেয়াল করো,প্রতিবারই কথা বলা তখন জায়েজ

হবে,যখন কথা বলার একান্ত জরুরত হবে,পাশাপাশি

অাকৃষ্ট হওয়ার অাশঙ্কাও থাকবে না।

--তাহলে অাপনিই বলুন,অাম্মাজান অায়শা কি হাজার

হাজার সাহাবাকে হাদীস শিক্ষা দেন নি?কিভাবে

দিয়েছেন?

--উনি দিতে পেরেছেন,কারণ পরিস্থিতি উনার অনুকূলে

ছিল।রসূলুল্লাহর ওফাতের পর তার স্ত্রীদের অন্য পুরুষ

কর্তৃক বিবাহ করা হারাম ছিলো।পাশাপাশি

সাহাবাদের ঈমান এতই তেজদীপ্ত ছিলো যে,তারা দৃষ্টি

অবনত রাখতেন,অাম্মাজানের প্রতি অাকৃষ্ট হওয়া তো দূর

কি বাত,সর্বদা সকল প্রকার কলুষতা থেকে মুক্ত থাকার

চেষ্টা করতেন।কিন্তু তোমার পরিস্থিতি তো

ভিন্ন,তাইনা বলো?

অামি চোখ বন্ধ করে মনের গভীর থেকে রব্বের কাছে

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।অার অামার শায়খকে যাতে

ইহকাল অার অাখিরাত,উভয় কালেই জাযাহ দেন,তা

প্রার্থনা করলাম।চোখ খুলে দেখি অামার শায়খ

ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে অাছেন অামার দিকে।এবার

অামি ঠিক উনার উল্টোটা করলাম,তাকে চোখ মারলাম!!

প্রথমবারের মতন।তারপরই মোবাইলটা হাতে নিয়ে

ফেসবুকে লগিন করলাম।এখন অামার কি করণীয়,অামি তা

জানি।

ইনশাআল্লাহ চলবে.........



"শায়খ"

পর্ব নয়.....

ফজরের পর উনি কুরঅান নিয়ে এসে বললেন,

--এই নাও।অাজ তুমি কুরঅান পড়ো তো,অামি দেখি,

কোথাও ভূল হয় কিনা।

--অাপনার মুখে মুখে পড়লেই তো সঠিকভাবে পারব

কুরঅান পড়তে।

--না অামিনা,পারবে না।

--কারণ?

--কারণ হচ্ছে,তাজউইদ!কুরঅান তাজউইদের সাথে

তিলাওয়াত করা ফরজ।নাহয় অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে।

যেমন ধরো,অামাদের কালিমা তাইয়্যিবার প্রথম অংশ

কি বলোতো?"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" না?এবার এটার

অর্থ বলো তো?

--হ্যাঁ....অর্থ হলো,অাল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

--এই দেখো,এই 'লা' বলার সময় একটা টান অাছে।দেখো

তোমায় অারবীটা দেখাই,এটা কি?লাম অালিফ যবর লা..

না?কিন্তু তুমি যদি টান না দিয়ে পড়ো,তাহলে সেটা হবে

'লাম' যবর লা,তখন এই পূর্ণ কালিমার অর্থ বদলে যায়,তখন

এই কালিমার অর্থ হবে,'আল্লাহ ছাড়া নিশ্চয়ই মাবুদ

আছে'

নাউযুবিল্লাহ,দেখলে তো কিভাবে অর্থটা বদলে গেল?

অাবার দেখো,সূরা ইখলাসের প্রথম অায়াত,ক্বুল হু

ওয়াল্ল হু অাহাদ।খেয়াল করো,শুরুতে যে হরফ

অাছে,সেটা কিন্তু কাফ( ﻙ ) নয় ক্বফ ( ﻕ )।এই হরফটা

উচ্চারণের সময় তোমায় একটু ধাক্কা দিয়ে উচ্চারণ করতে

হবে।তখন এই ক্বুল শব্দটির অর্থ হবে বলো,অার পুরো বাক্য

'ক্বুল হু ওয়াল্লহু অাহাদ' এর অর্থ হবে,'বলো,তিনিই

অাল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়'।

কিন্তু তুমি যদি ক্বুল শব্দটা উচ্চারণের সময় ক্বফের উপর

জোর না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে 'কুল' পড়ে যাও,তখন পুরো

বাক্যটির অর্থ হবে,'খেয়ে ফেলো অাল্লাহ

এক',অাস্তাগফিরুল্লাহ!

তারপর অাবার দেখো,একই রকম যেসব অক্ষর অাছে,যেমন

ক্বফ( ﻕ )-কাফ( ﻙ ) , হা( ﺡ ),-হা( ﻩ ),অা

লিফ( ﺍ )-অাইন( ﻉ ) - হামযা( ﺀ ),ছা( ﺙ ) - সোয়াদ( ﺹ )-সিন

( ﺱ ) ,তা( ﺕ )-ত্বোয়া( ﻁ ),জিম( ﺝ )-যাল( ﺫ ) -যোয়া

( ﻅ ),লাম( ﻝ ) -লামঅালিফ( ﻻ) .. ....

এই শব্দের উচ্চারণ গুলো কিছুটা কাছাকাছি বলে অামরা

একই উচ্চারণ দিয়ে সমজাতীয় সবগুলো হরফকে উচ্চারণ

করি।বাস্তবিকভাবে তোমার মনে হবে,এটা তো নরমাল ই।

কিন্তু অাসলে তা না!এটার জন্য

অর্থের কত মারাত্মক বিকৃতি হয়ে যায়!

--বুঝলাম শায়খ,বুঝলাম.....

এখন অাপনি বলুন তো,অাপনি মাশাঅাল্লাহ এত কিছু

কিভাবে জানেন?হিফয করেছিলেন?

--নাহ,হিফয করার সৌভাগ্য অামার হয়নি।অার

কেবলমাত্র হিফয করলেই সহীহভাবে পড়তে পারব,নাহয়

পারব না,এটা কে বললো অামিনা?তাজউইদ শেখা তো

ফারজে অাইন।সেটা শেখা তো প্রত্যেকটা মুসলমানের

উপর ফরজ।

--ফারজে অাইন?সেটা অাবার কি?

--সেটাও এক প্রকার ফরজ অারকি।

--মানে?ঠিক বুঝলাম না।

--ফরজ মানে কি বলো তো?ফরজ মানে হলো যেটা করতেই

হবে,অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় কাজ,বুঝেছ?

--হু,তা তো জানি ই।

--অার এই ফরজ দুই প্রকার,

১.ফারজে অাইন।

২.ফারজে কেফায়া।

এখন অাসি ফারজে অাইন নিয়ে কেমন?

প্রাপ্ত বয়স্ক সবার উপর যাই বাধ্যতামূলক তাই ফরজে

অাইন। যেমন,পাঁচওয়াক্ত নামাজ ও রমজানের

রোজা,সামর্থ্য হলে হজ্ব,যাকাত,পর্দা,তাজউইদসহ

কুরঅান তিলাওয়াত,ইত্যাদি।

অার ফারজে কেফায়া হলো,যা মুসলমানের জন্য ফরজ

কিন্তু সবার পক্ষ থেকে একজন পালন করলে সবার অাদায়

হবে তা।

যেমন, জানাযার নামাজ,হিজরী তারিখের হিসাব

রাখা,পরশুদ্ধি ইত্যাদি.....

বুঝলে?ক্লিয়ার হলো?

--হু,বুঝলাম।অাচ্ছা,এখন তো সকাল হয়ে গেছে।অামরা

কালকে থেকে পড়বো কেমন?

--না,এখন থেকেই পড়বো।জানো সূরা মুযযম্মিলের চার নং

অায়াতে অাল্লাহ অামাদের স্পষ্টভাবে কুরঅান

তিলাওয়াতের অাদেশ দিয়েছেন।অার জানো হাদিসে

অাছে,"তোমরা তোমাদের ধ্বনির সাহায্যে কুরআনকে

সুষমামন্ডিত কর, অথবা তোমরা কুরআনকে তাজউইদ ও

তারতীলের সাথে সুন্দরভাবে পাঠ কর।"

সম্ভবত এটা অাবু দাউদের ১৪৬৮ নং হাদিস।এখন দেখি

এদিকে এসো।খাতাটা দাও।অামি লিখছি তাজউইদ

কি.........

ইনশাআল্লাহ চলবে....




"শায়খ"

পর্ব দশ.....

--বুঝলে অামিনা,এই তাজউইদ জিনিস টা কিন্তু খুবই মজার

একটা বিষয়।প্রথমে দেখ,'মাখরাজ,সিফাতুল হুরুফ বা

হারফের বৈশিষ্ট্য,নুন সাকিন,তানউইন,মিম

সাকিন,উচ্চারণের পদ্ধতি,মাদ,ওয়াক

ফ,ইবতিদা'

মাত্র এই অল্প কয়টা পার্ট নিয়েই কিন্তু তাজউইদ গঠিত।

কাজেই তাজউইদ শিখতে খুব একটা কষ্ট হবেনা

ইনশাআল্লাহ!তাহলে শুরু করি?

--করুন।

--আরবী শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মাখরাজের গুরুত্বের শেষ

নেই।মাখরাজ হলো অারবী শব্দগুলো উচ্চারণের স্থান।

যেমন অামরা বাংলা বর্ণমালার সাতটি উচ্চারণ স্থল

অাছে,তেমনই অারবী বর্ণমালার সতের টি উচ্চারণস্থান

অাছে।

--বাংলা বর্ণমালারও উচ্চারণ স্থল অাছে!!!!

--হ্যাঁ,থাকবে না কেন?তুমিই দেখো না,"ম" বর্ণটা উচ্চারন

করতে তোমায় যেমন দুই ঠোঁটের সাহায্য নেওয়া

লাগে,"ক" বর্ণ উচ্চারণ করতেও কি দুই ঠোঁটের প্রয়োজন

হয়?

--না,তা না।কিন্তু.......

অাচ্ছা সাতটা স্থান কি কি,একটু বলুন তো!

--বলতে গেলে তো দেরি হয়ে যাবে অামিনা।পরে বলবো

নাহয়,অাগে মাখরাজ গুলো সম্পর্কে শুনো।

--না না,মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছে।অাগে ওটা সমাধান

করতে হবে।

--কি চিন্তা?কিসের সমাধান?

--অাসলে,অারবী বর্ণমালা সবগুলোই তো বাংলায়

উচ্চারণ করা যায়।তাহলে বাংলা বর্ণমালা উচ্চারণের

স্থান সাতটি,কিন্তু অারবী বর্ণমালা উচ্চারণের স্থান

সতেরো টি...........

বিষয়টা কেমন এলোমেলো লাগছে না?যেমন ধরুন 'বা( ﺏ )'

এর কথা।বাংলায় ব এর সাথে অাকার যোগ করলেই তো

অারবীতে বা( ﺏ ) উচ্চারিত হয়।অাবার ধরুন "হা( ﺡ )" এর

কথা,বাংলায় হ এর সাথে অাকার যোগ করলেই তো

অারবীতে হা( ﺡ ) এর উচ্চারণ হবে।

অর্থাৎ অারবী সবগুলো হরফের উচ্চারণ তো বাংলা

হরফের দ্বারা করা যায়,তাইনা?তাহলে বাকি দশটি

অতিরিক্ত স্থানের কি দরকার উচ্চারণের জন্য?

--এটাই তো পয়েন্ট অামিনা।তুমি দেখো,অামি কিন্তু

প্রতিবারই বলছি "তাজউইদ" কিন্তু বাংলায় পড়তে গেলে

তুমি সবজায়গায় এই শব্দটাকে পাবে 'তাজবীদ' হিসেবে।

এখন বলো,কোনটা সঠিক হওয়া উচিৎ?

--অবশ্যই তাজবীদ।

--না,তাজউইদ সঠিক হবে।কারণ অামরা ছোটবেলায় ওয়াও

( ﻭِ ) যের 'বি( ﺏِ )' শিখি,যেটার অাসল উচ্চারণ হবে ওয়াও

( ﻭ ) যের 'উই( ﻭِ )'।

বুঝলে?পাশাপাশি দেখবে,অারবীতে দেখবে 'জিম( ﺝ )-

যাল( ﺫ ) - যোয়া( ﻅ )-ঝা( ﺯ )' শব্দগুলোকে অামরা 'জ' এর

মতন করে উচ্চারণ করি।অর্থাৎ সবগুলোকে একই রকম করে

উচ্চারণ করি।কিন্তু এদের উচ্চারণ অালাদা অালাদা।

অামি একটু অাগেই তোমাকে দেখিয়েছি সামান্য

একটুখানি উচ্চারণের জন্য অায়াতের অর্থ কিভাবে

বদলে যায়,দেখিয়েছি না?

--হ্যাঁ,কিন্তু বাজারে যে বাংলায় অনুবাদ করা কুরঅান

শরীফ গুলো পাওয়া যায়,ওখানেও তো এই হারফগুলোকে

একইভাবে উচ্চারণ দেখায়।

--হ্যাঁ,ওটাই তো বলছি।তুমি পড়তে গেলে দেখবে জিমের

( ﺝ ) উচ্চারণ এক রকম,যাল( ﺫ ) এর উচ্চারণ অারেকরকম।

যোয়ার( ﻅ ) উচ্চারণ এক রকম,ঝার( ﺯ )উচ্চারণ অারেক

রকম।

কিন্তু বাংলায় খেয়াল করবে,এই হারফগুলোর উচ্চারণ

বোঝানোর জন্য "জ" অার "য" ব্যবহৃত হয়।অাবার

দেখো,ওয়াও( ﻭ ) এর উচ্চারণের সমমানের কোনও বাংলা

বর্ণ নেই বলে এটার উচ্চারণ বা( ﺏ ) এর মতন করা হয়।

ক্বফের( ﻕ ) উচ্চারণ লিখার সময় যদিও ক এর নিচে ব হসন্ত

দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এই উচ্চারণটা একটু ভিন্ন,তবুও

অামরা সাধারণ মানুষ না বুঝে "কাফ( ﻙ )" এর মত উচ্চারণ

করে ফেলি।অথচ এই দুইটা হারফের উচ্চারণে বিস্তর

পার্থক্য।এই একই অবস্থা তুমি দেখবে অন্যান্য অারবী

সমজাতীয় হুরুফের মাঝেও।অাসলে বাংলা শব্দ ভাণ্ডার

কানায় কানায় পূর্ণ হলেও অারবী হুরুফ উচ্চারণের সমান

উচ্চারণ পূর্ণ বাংলা শব্দ খুব একটা বেশী নেই।এবার

বুঝলে মাখরাজ সতেরো টি,কিন্তু বাংলা বর্ণমালার

স্থান সাতটি হওয়ার কারণ?

--জ্বি বুঝলাম।কিন্তু হারফ অার অার হুরুফ কি?

--অারবী প্রতিটা বর্ণকে অালাদা অালাদা ভাবে

বোঝালে তখন প্রতিটা অালাদা বর্ণকে হারফ

বলে,বাংলায় যেটাকে অামরা হরফ বলি অারকি।অার

হারফ হলো একের অধিক হরফের সমষ্টি।

--অর্থাৎ হারফ হলো বর্ণ,অার হুরুফ হলো

বর্ণমালা,তাইতো?

--ঠিক তাই।এবার এসো সিফাতুল হুরুফ নিয়ে কথা বলি।

সিফাত মানে তো জানো ই,গুণ বা বৈশিষ্ট্য।সিফাতুল

হুরুফ হচ্ছে হারফগুলোর বৈশিষ্ট্য।এটা ভিন্ন ভিন্ন

হারফের উচ্চারণ যাতে একই না হয়,সে দিকটা নিশ্চিত

করে।তারপর দেখো,নুন সাকিন অার তানউইনে।

এর অাগে অামি তোমাকে হারকাতের সংজ্ঞা বলি

কেমন?বাংলায় যেমন অা-কার(া),ই-কার(ি),দীর্ঘ-ই কার

(ী) অাছে।তেমনই অারবী হারফ দ্বারা শব্দ গঠনের জন্য

যবর,যের,পেশ অাছে।বাংলায় যদি তুমি বলো 'অম বংলদশ

থক' তাহলে কি এটার কোনও অর্থ অাছে?নেই না!

কিন্তু তুমি যখন স্বরচিহ্ন যোগ করে বলবে,

'অামি বাংলাদেশে থাকি' তখন এটা কেবলমাত্র শব্দেই

না,অাদর্শ একটি বাক্যেও পরিণত হয়।তেমনভাবেই

অারবী বর্ণ 'অালিফ,লাম,হা,মিম,দাল,লাম,হা' একত্রিত

করে ' ﺍﻟﺤﻤﺪﻟﻪ ' বললে এটা কোনও বাক্য তো দূরে থাক,শব্দই

হবে না।কিন্তু যখনই তুমি এই হারফগুলোতে

যবর,যের,পেশ,সাকিন যু্ক্ত করবে,তখন এটি

"অালহামদুলিল্লাহ" তে পরিণত হবে।যা কেবলমাত্র

একটি শব্দ ই না।বরং একটি সফল বাক্যও বটে।এখন

দেখো,এক যবর,এক যের অার এক পেশ কে হারকাত বলে।

বুঝলে?

অার সাকিন মানে তো জানো ই,জযম।নুন সাকিন মানে

হলো সাকিনযুক্ত নুন,বা এমন নুন,যেই নুনে হারকাত নেই।

অার তানউইন হলো দুই যবর,দুই যের,এবং দুই পেশ বুঝলে?

--বুঝলাম,তারপর?

--তারপর হলো মিম সাকিন।মিম সাকিনও নুন সাকিনের

অনুরূপ। অর্থাৎ সাকিনযুক্ত মিমকেই মিম সাকিন বলে।

এরপর হলো মাদ।মাদ অর্থ টেনে পড়া।একটু অাগে বললাম

না,'লা ইলাহা ইল্লাল্লহ' পড়ার সময় 'লা' তে এক অালিফ

টান দিতে হবে।তেমনই তুমি দেখবে কুরঅান শরীফে তুমি

দেখবে কিছু কিছু স্থানে,কিছু কিছু হুরুফে টান দিতে

হচ্ছে।এই টান দেওয়াটা ই হলো মাদ করে পড়া।

--কিন্তু অামি বুঝবো কিভাবে কোথায় কোথায় মাদ

করতে হবে?

--এটা তো সোজা।মাদের নির্দিষ্ট তিনটি হারফ অাছে।

পাশাপাশি এর কিছু নিয়মও অাছে।অপেক্ষা করো

অাহলিয়া,ধীরে ধীরে শিখবে।

--অাচ্ছা,তারপর?

--তারপর অার মাত্র তিনটা টপিক,ওয়াকফ,ইবতিদা অার

উচ্চারণের পদ্ধতি।ওয়াকফ মানে হলো থেমে যাওয়া।এর

নির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন অাছে।অার ইবতিদা মানে হলো শুরু

করা।ওয়াকফ করার পর পড়া অাবার শুরু করাটা হলো

ইবতিদা।বুঝলে?

--হ্যাঁ বুঝলাম।অার উচ্চারণের পদ্ধতি বলতে?মাখরাজ

পড়লেই তো বোঝা যাবে হুরুফের উচ্চারণ সম্পর্কে।

--না অাহলিয়া,বোঝা গেলেও সম্পূর্ণ ভাবে বোঝা

যাবেনা।

মাখরাজ হলো কোন হারফ কোন স্থান হতে উচ্চারিত হবে

সেই স্থান গুলোর পরিচয়।অার উচ্চারণের পদ্ধতি বলতে

অামি বুঝিয়েছি উচ্চারণ গুলো কেমন হবে,হালকা না

ভারী,মোটা না চিকন,এইগুলো।

--অাচ্ছা,বুঝলাম তারপর?

--তারপর অার কি?অামি তোমাকে তাজউইদ সম্পর্কে

প্রাথমিক ধারণা দিলাম।এখন তোমার কাছে দুইটা অপশন

অাছে।

১.পাশের এলাকায় একটা মহীলা মাদরাসা অাছে

সেখানে গিয়ে তাজউইদ সহ কুরঅান তিলাওয়াত শেখা।

২.বাসায় একজন উস্তাযা রেখে শেখা।

তুমি কোনটা করতে চাও?

--মানে টা কি?অাপনি শেখাবেন না?

--না।

--কেন?

প্রশ্ন শুনে শায়খ একপ্রকার চমকে অামার দিকে

তাকালেন।

অাসলে কথাটা থমথমে গলায় বলে ফেলেছি।অবশ্য বলতে

গিয়ে কণ্ঠটা একটু ধরেও এসেছিল।মনে একরাশ অভিমান

জমা হয়েছে।অাসলে সমস্যা টা কোথায়!এই মানুষটা যদি

এভাবেই ভালবেসে অামাকে তাজউইদ শেখায় তাহলে

কি এমন হবে?চোখ ঝাপসা হয়ে অাসছে।অামার এই এক

স্বভাব।পান থেকে চুন খসলেই কষ্ট লাগে,কান্না অাসে।

সম্ভবত অামার এই অবস্থা দেখেই উনি ব্যস্ত হয়ে উঠে

দাঁড়ালেন।অামার সামনে এসে হাঁটুগেড়ে বসে হাতগুলো

উনার হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন।খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন,

--অামিনা!তোমার চোখে পানি কেন?অামি কি তোমায়

কষ্ট দিয়েছি?

অামি তো তোমার ভালোর জন্যই উস্তাযা কিংবা

মাদরাসায় গিয়ে পড়ার কথা বলছি।অামি চাই অামার

অাহলিয়া একদম সহীহ ভাবে কুরঅান শিখুক।পাশাপাশি

ছোট ছোট সূরা গুলো অাস্তে অাস্তে মুখস্থ করে ফেলুক।

বড় সূরা গুলো নাহয় অামরা একসাথে মুখস্থ করবো।

এখন তুমি বলো তো,মাদরাসায় গিয়ে পড়বে?অবশ্য অামার

কাছে ঘরে উস্তাযা রেখে শেখাটাকেই ভালো মনে

হচ্ছে।

অামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালাম।শায়খের

কথায় যুক্তি থাকলেও অামার উনার এই সিদ্ধান্ত পছন্দ

হয়নি।উনার কাছ থেকেই তো কত সুন্দর করে শিখতে

পারতাম!ভালোই তো লাগে এভাবে শিখতে,তারপরও

উস্তাযা কেন......!

--বেলা হয়ে যাচ্ছে।অামি উঠি,অামায় নাস্তা বানাতে

হবে।

বলে চলে অাসছিলাম।হটাৎ উনি বলে উঠলেন,

--একটা সুখবর অাছে অাহলিয়া।খোঁজ নিয়েছি অামি।

অামাদের এলাকাতেও মহীলাদের তালিম হয়,প্রতিদিন

হয়।খোঁজ নিয়ে দেখলাম নির্ভরযোগ্য, তুমি গিয়ে দেখতে

পারো।

--কোথায় হয়?কারো বাড়িতে?

--হ্যাঁ,অামাদের এলাকায় যে বড় মাসজিদটা অাছে,ওই

মাসজিদের মুয়াজ্জিনের বাসায়।সার্বিক তদারকি উনার

স্ত্রী ই করেন।উনার স্ত্রী অার চার মেয়ে।এর মাঝে ছোট

মেয়েটা মিশকাতে পড়ছে।বাকি তিনজনই অালিমা অার

ওদের মাও অালিমা।তোমার কোনও সমস্যা হবে না

ইনশাআল্লাহ।

উনার এই কথা শুনে সব অভিমান কোথায় যেন মিলিয়ে

গেলো।মন চাচ্ছিলো এখনই দৌঁড়ে শ্বাশুড়ি মাকে নিয়ে

তালীমে যেতে।কখনও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।না জানি

কত সুন্দর হবে তালীমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা টা।অামি

চোখ বুজে খানিকটা শব্দ করে অালহামদুলিল্লাহ বলে

উঠলাম।

--কি গো অাহলিয়া?অামি এত কষ্ট করে খোঁজ নিলাম।

অার অামার অাহলিয়া অামায় ধন্যবাদটুকুও দিলো না!

কপট অভিমানের সাথে বললেন শায়খ।অামি লজ্জায়

চোখ নিচু করে ফেললাম।অাসলেই তো উনাকে ধন্যবাদ

দেওয়া উচিৎ। অাস্তে করে বললাম,

--ঠিক অাছে,খোঁজ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

--উঁহু,ধন্যবাদ নয়।বলো "জাযাকাল্লাহু খয়রন"।এটা সুন্নাহ

তো।

--এই বাক্যটা অনেক জায়গায় দেখেছি অামি।এটার

মানে কি?

--এটার মানে হলো,"অাল্লাহ অাপনাকে উত্তম প্রতিদান

দিন।"

অার কেউ যদি তোমাকে জাযাকাল্লাহু খয়রন বলে,

তাহলে তুমি তাকে উত্তর দিবে,'ফা জাযাকুমুল্লাহু খয়রন'

বলে,কেমন? অবশ্য 'ওয়া অান্তুম ফা জাযাকাল্লাহু

খয়রন,ওয়া ইয়্যাক' ও বলা যায়।

এর অর্থ হবে,"আল্লাহ আপনাকেও উত্তম প্রতিদান দিন"।

বুঝলে?

--হ্যাঁ,বুঝলাম।এবার রান্নাঘরে যাই কেমন?অাসসালামু

অালাইকুম।

ইনশাআল্লাহ চলবে.......





"শায়খ"

পর্ব এগারো....

বেলা তিনটা করে মাকে সাথে নিয়ে গেলাম তালিমে।

মাকে রাজি করাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি অামার।

যখন নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছালাম,অামার গলা শুকিয়ে

যাচ্ছিলো,হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছিলো,এক ধরণের অজানা

অাতঙ্ক হচ্ছিলো।বরাবরই শুনে এসেছি এইসব তালিমে

জাল,বানোয়াট,বিদঅাতি মাসঅালার শিক্ষা দেয়,তবুও

ভরসা,শায়খ বলেছেন এই তালিম টা নির্ভরযোগ্য।

পাশাপাশি তিন মেয়ে সহ মা অালিমা,অারেক মেয়ে

মিশকাতে পড়ছে,বাবা মুয়াজ্জিন,গড়মিল থাকার কথা

না।অাল্লাহর নাম নিয়ে দরজায় নক করলাম।পরপর

তিনবার নক করতেই খুলে গেলো।অাপাদমস্তক ঢাকা

একজন এসে সালাম দিয়ে মুসাফাহা করলেন,ভেতরে

গিয়ে বসতেই দেখি প্রায় জনা ত্রিশেক

নারী,বেশীরভাগ ই অামার বয়সী।এটা ভেবে ভালো

লাগলো যে,তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ এখনও অামার

রব্বের হিদায়াহর ছায়ায় অাছে।অালহামদুলিল্লাহ,সুম্মা

অালহামদুলিল্লাহ!!

নিকাবটা খুলবো কিনা তা নিয়ে একটু ইতস্তত করছিলাম।

এগিয়ে এলেন সেই অান্টি টি।নিজের নিকাব খুলে

অামায়ও নিকাব খুলতে বললেন।গ্লাসে করে পানি

এগিয়ে দিলেন পরম অাদরে,মুখে প্রশস্ত এক হাসি,ঠিক

অামার শায়খের মতন।এক মুহূর্ত ভাবলাম,যারা একটুখানি

দ্বীনের পথে চলে,তাদের দেখলেই বুঝি মন ভরে যায়!

অামার শায়খ,এই যে পঞ্চাশোর্ধ অান্টি,তালিমের

বাকি মানুষগুলো।একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে রেখেছিলো

অামায়।

সেদিনের অালোচ্য বিষয় ছিলো "নামাযের গুরুত্ব,স্বলাত

অাদায়ে উদাসীনতা অার বে নামাযীর শাস্তি"।অামি

অবাক হচ্ছিলাম অান্টির উপস্থাপনা দেখে।নামাযের

গুরুত্ব বলতে বলতে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো,বে

নামাযীর শাস্তি বলার সময় হুহু করে কেঁদে উঠছিলেন

তিনি।অাশপাশের সবার চোখ ভেজা,এমনকি অামার

শাশুড়ি মায়েরও।ওই অান্টিটা যখন বলছিলেন,

"তোমরা কিছু করো না অার না করো,নামায অাদায়

করো।সময় বয়ে যায়,কে কখন চলে যাব অামাদের অাসল

বাড়িতে।তখন অামাদের ঝুলিতে একমাত্র অামল ছাড়া

কিছু তো থাকবেনা।একমাত্র নামাযই অামাদেরকে

হিসাব নিকাশের পর সাকারে যাওয়া থেকে দূরে রাখতে

পারবে........."

অামি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।তার বাচনভঙ্গি এমন

ছিলো যে অামার অন্তর কেঁপে উঠছিলো।সম্বিৎ ফিরলো

অাসরের অাজান শুরু হওয়ার সময়।একসাথে সবাই

অাযানের উত্তর দিলাম।অাযান শেষে দুঅা করলাম।

তারপর সবাই হাত তুলে মোনাজাতে দুঅা করলাম।

মোনাজাতের পর সবাইকে দুটো করে খেঁজুর অার

একগ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে দেওয়া হলো।ফেরার সময়

খেয়াল করলাম মা যিকর করছেন,বিভ্রান্ত

ের মতন এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।সারা রাস্তা অামার

সাথে কথা বলেন নি।ঘরে গিয়ে নামায পড়ে

কাঁদলেন,অনেক কাঁদলেন।মনের ভেতর তখন কেমন অনুভূতি

হচ্ছিলো বলে বোঝাতে পারবো না,এটাই ছিলো অামার

উপর,অামার শাশুড়ি মায়ের উপর অামার রব্বে কারীমের

নিয়ামত,

সুবহানআল্লাহ!অালহামদুলিল্লাহ!অাল্লাহু অাকবার!!!

যতই দিন যাচ্ছিলো,মা একটু একটু করে দ্বীনের পথে

অাসছিলেন,বাসায় নামাযের সময়সূচীর চিরস্থায়ী

ক্যালেন্ডার থাকা সত্ত্বেও মা একটু পরপর এসে

জিজ্ঞেস করতেন,

"এই মেয়ে,দেখো তো তোমার মোবাইলে,নামাযের

ওয়াক্ত হলো কিনা"।

অারও খেয়াল করলাম মা চাশতের,ইশরাকের নামাযও

পড়ছেন। সালাতুত তাসবীহ অার তাহাজ্জুদ তো একদমই

ছাড়ছেন না।ওয়াক্ত হওয়ার পরও অামি যদি একটু বিলম্ব

করতাম নামায পড়তে,মা কড়া গলায় ধমকাতেন।বলতেন,

"কি হ্যাঁ?নামায পড়বে না নাকি?ফিরিশতাদেরকে বলিও

না যে সংসারের কাজ সামলাতে গিয়ে নামায পড়তে

পারোনি।অবশ্য বললেও লাভ হবে না।তাড়াতাড়ি

যাও,নামায পড়ো।পরে হাজার অামল থাকলেও যদি এই

নামাযের জন্য তোমাকে সাকারে যেতে হয়,তাহলে

কিন্তু অামি বেহেশতের কোনও হুরপরির সাথে অামার

ছেলের বিয়ে দিয়ে দিব।"

মায়ের ধমক শুনে অামি হাসতাম,দ্বীনের পথে প্রথম প্রথম

এলে চল্লিশোর্ধ কেউ ও যে ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ের

মতন শিশু হয়ে যায়,তা অামি স্বচক্ষে এই প্রথমবারের মতন

দেখলাম।মাঝেমাঝে উনার অামল করা দেখলে অামারই

হিংসা হতো।প্রতিযোগীতা করে অামল শুরু করেছিলাম

মায়ের সাথে।সেই অনুভূতিগুলো অন্যরকম,একদম অন্যরকম।

হটাৎই একদিন তালিমে "স্ত্রীর অধিকার,স্ত্রীর কর্তব্য"

নিয়ে অালোচনা হচ্ছিলো।তীব্রভাবে ঝাঁকি খেলাম

যখন অান্টি বললেন,

"জাহেলিয়াত!জাহেলিয়াত!!এটা সম্পূর্ণ জাহেলিয়াত!

দেওর ভাবির কাছে মৃত্যুর সমান হওয়া সত্ত্বেও মানুষ

ভাবিকে দেওরের মায়ের সমান বলে তূলনা করে।দেওর

ভাবির মাঝে কোনও পর্দা নেই,যা তা অবস্থা।তার উপর

সমাজের একটা ধারণা হয়েছে বউ শ্বশুড়-শাশুড়ির সেবা

করবে,একটু এদিক সেদিক হলে সংসারে অশান্তি থেকে

শুরু করে তালাক পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে,যেন এটা ফরজ

ওয়াজিব কিছু।অাহারে মায়েরা শুনুন,ছেলের বউ

অাপনাদের জন্য যা কিছু করে,তা একপ্রকার সাদকাহ

অার মানবিকতা।এটার জন্য ওরা কিন্তু বাধ্য না।অথচ

সমাজের নীতি হলো এমন,শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সেবা করবে

ছেলের বউয়েরা,অার নিজের মা বাবা চুলোয়া

যাক,তাতে কার কি"......"

অামি খেয়াল করলাম মা সবটুকু কথা যেন গোগ্রাসে

গিলছেন।সারা পথ গম্ভীর ছিলেন।অামার শায়খের একটা

স্বভাব হলো তিনি এসে অাগে মায়ের খোঁজ নেন।মায়ের

জন্য এটা সেটা নিয়ে অাসেন।মায়ের হাই

বিপি,পাশাপাশি ইদানিং মায়ের ডায়াবেটিস সহ অারও

এই সেই অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে।প্রতিদিন গিয়ে শায়খ

চেক করে অাসেন মায়ের ওষুধ খাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে

কিনা।সেদিন শায়খ অাসার অাধঘন্টা অাগ থেকেই মা

ছটফট করছিলেন,বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন।শায়

খ ফেরার পরপরই মা উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,

--বেটা তুই তো ইসলাম নিয়ে পড়িস অনেক।তুই জানবি

নিশ্চয়।শ্বশুড় শাশুড়ির সেবা করা নাকি ফরজ না?

--হ্যাঁ,না ই তো।হাদিসে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি

ওয়া সাল্লাম তাকে অভিশাপ দিয়েছেন,যার জীবদ্দশায়

মা-বাবা কিংবা কেবলমাত্র একজন বেঁচে থাকা

সত্ত্বেও যে তাদের সেবা না করে জাহান্নামে যাবে।

পাশাপাশি একবার এক লোক,রসূলুল্লাহর কাছে জিহাদে

যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি ওই ব্যাক্তিকে ঘরে গিয়ে

নিজের বাবা মায়ের সেবা করতে বলেছেন।তুমি খেয়াল

করো,একবারও কিন্তু শ্বশুড় শাশুড়ির কথা বলেন নি।

অাসলে মা যার যার বাবা মায়ের খিদমাহ করার দায়িত্ব

তার তার।

--তাহলে এই মেয়েটা অামার খিদমত করে কেন?

অামার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন মা।

--অামিনা?ও তো তোমাকে ভালবেসে করে,বেশী বেশী

নেকি কামাই করে জান্নাতে যাওয়ার জন্য করে।

--কিন্তু ও যদি ওর বাবা মায়ের খিদমত না করে,তাহলে

ওর গুনাহ হবে না?

--উঁ,হতে পারে।

--তখন ফিরিশতারা কারণ জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় ও

বলবে শাশুড়ির সেবা করতে গিয়ে বাবা মায়ের সেবা

করতে পারেনি।

--হ্যাঁ,এটাও বলতে পারে।

--তাহলে শুন,একটা কাজ কর।টেবিল থেকে খাতাটা নে

তো।অামি বলছি তুই লিখা শুরু কর।

১.প্রতি মাসে বাবা মায়ের কাছে বড়জোর দুইদিনের জন্য

যেতে পারবে।অবশ্য অসুখ বা কোনও সমস্যা থাকলে

অারও বেশিদিন বাবার বাড়িতে থাকতে পারে,সমস্যা

নেই।

২.প্রতিদিন ফোনে বাবা মায়ের খোঁজখবর নিতে হবে।

৩.প্রতি মাসে তাকে নির্দিষ্ট কিছু টাকা দেওয়া

হবে,সেটা দিয়ে বাবা মায়ের জন্য এটা সেটা হাদিয়া

কিনে নিবে।

৪.বাবা মায়ের অসুস্থতার খবর শুনলে যত বড় সমস্যার

মাঝেই থাকুক ও,বাবা মায়ের কাছে গিয়ে খিদমত করতে

হবে।

৫.বাবা মাকে কখনও অসম্মান করে কিছু বলতে পারবেনা।

৬.প্রতিদিন তাদের জন্য দুঅা করতে হবে।

৭.উঁ....মনে পড়ছেনা অার।অাপাতত এগুলো থাক।এতটুকু

লিখে নিচে লিখ "এসব শর্ত অামি সজ্ঞানে মেনে

নিলাম।",তারপর নিচে ওর নাম লিখ,দুইপাশে সাক্ষীর

নাম হিসেবে অামার অার তোর নাম লিখ।

লিখা হলে খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে মা অামার সাক্ষর

নিলেন,শায়খের সাক্ষর নিলেন,নিজে সাক্ষর করলেন।

তারপর খাতা হতে পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ভাজ করতে করতে

বললেন,

--শুনো মেয়ে,তুমি অাবার বলিও না অামার জন্য বাবা

মায়ের খিদমত করতে পারো নি।হাশরের দিন কিন্তু তুমি

অামাকে কোনওভাবে ফাঁসাতে পারবেনা।অাগে নিজের

জান্নাত ঠিক করো যাও,বাবা মায়ের খিদমত করো

অাগে,অামার খিদমত করার জন্য অামার পাঁচ ছেলেই

কাফি।

মায়ের কাজকর্ম দেখে শায়খ মিটিমিটি হাসছেন,অামার

চোখ ঝাপ্সা হয়ে অাসছিলো,মন চাচ্ছিলো গিয়ে মাকে

জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি।কিন্তু কি একটা জড়তা কাজ

করছিলো কে জানে,অামি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম।

মা সালাম দিয়ে চলে গেলেন।অামি তখনও ধাতস্থ হতে

পারছিলাম না।শায়খ পরম যত্নে অামায় কাছে টেনে

নিলেন।থুতনীটা একটু উঁচু করে ধরে বললেন,

--তোমার চোখে হটাৎ হটাৎ পানি কেন অাসে অাহলিয়া?

এখন তো তোমার খুশি হওয়া উচিৎ,এটা তো তোমারই

প্রচেষ্টার ফল।তুমিই তো....

--না না!এটা অামার প্রচেষ্টার ফল না।বরং এটা তো

অামার প্রতি অামার রব্বের করুণা,অালহামদুলিল্লাহ!

শায়খ জোড়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,

--অাল্লাহু অাকবার!অামিনা!তুমি জানোনা অামি কত

সৌভাগ্যবান।অামার রব্ব শুধু অামায় চক্ষু শীতলকারী

স্ত্রী ই দেননি,বরং অামার পরিবারে রহমত ঢেলে

দিয়েছেন।মনে হয় একটুকরো জান্নাত দিয়েছেন অাল্লাহ

তোমায় দেওয়ার মাধ্যমে।অালহামদুলিল্লাহ!!সুম্ম

া অালহামদুলিল্লাহ!

অামি লজ্জা পেয়ে উনার বুকে মুখ লুকালাম।উনি নন,বরং

অামিই তো সৌভাগ্যবতী,যে কিনা এত পরহেজগার

কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।উনি অাচমকা

বলে উঠলেন,

--এই অামিনা,উঠো তো,খিদা পেয়েছে অামার।অামি

ভাত বাড়ি,তুমি গ্লাসে পানি ঢালো,দুটো খেঁজুর বের

করে নাও।তাড়াতাড়ি করো।

অামি মৃদু হেসে উঠে পড়লাম,এটা তো সেই প্রথম দিন

থেকেই রুটিন হয়ে গেছে।একদিন উনি ভাত বাড়বেন,অামি

গ্লাসে পানি ঢেলে খেঁজুর নিয়ে অাসবো,অারেকদিন

অামি ভাত বাড়বো,উনি গ্লাসে পানি ঢালা অার খেঁজুর

নিয়ে অাসার কাজ করবেন।খাওয়া শেষে একদিন অামি

প্লেট বাটি ধুবো,উনি বিছানা করবেন,অারেকদিন উনি

ধোয়ার কাজ করবেন,অামি বিছানা করবো।এখন অামরা

প্রায়ই একই প্লেটে খাই,একই গ্লাসের একই পাশে মুখ

লাগিয়ে পানি খাই।রসূলুল্লাহকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তিনি সবসময়ই এগিয়ে।

ইনশাঅাল্লাহ চলবে.....





"শায়খ"

পর্ব বারো.....

--ওরে অাল্লাহ রে.......

এত্ত বড় সাপ কেন!

অামিনা!ও অামিনা!বের হও,বের না হলে দরজা খুলো......

খুলো না কেন?দরজা খুলো তাড়াতাড়ি,এত্ত বড় সাপ!!!

গোসলের জন্য গোসলখানায় গিয়েছিলাম,এক মিনিটের

মাথায় ই শায়খের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি দরজা

খুললাম।দরজা খোলা মাত্র উনি তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে

ঢুকলেন।অামি তো ভয়ে চুপসে গেছি,অাসলেই কি সাপ?

--কি হলো?কোথায় সাপ?এত অশান্ত হয়ে অাছেন কেন?

--ইয়া অামিনা,অার বলিওনা,কত বড় সাপ।ওমাগো!অামি

দেখেই ভয় পেয়ে গেছি,তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

--সাপ!!কোথায়?দরজার ফাঁক দিয়ে যদি ওঘরে চলে যায়?

অাপনি সাপটাকে কিছু দিয়ে বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলতে

পারলেন না?যদি কাউকে কামড় দেয়?

ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম অামি।

--না...অাসলে,

ওটা তো কাউকে কামড় দিতে পারবেনা।দরজার ফাঁক

দিয়ে কিভাবে বের হবে?ওটা তো নড়তে পারছে

না,কিন্তু কত বড় সা....

--নড়তে পারছে না?তার মানে অাপনি মেরে ফেলেছেন

সাপটাকে?অাপনি কি পাগল?জানেন না অনেক সময়

জ্বীনেরা সাপের রূপ ধারণ করে চলে অাসে।তাই সাপ

মারার অাগে তিনবার বলতে হয় জ্বীন হলে চলে যেতে!

এটা হাদিসে অাছে।এখন যদি কোনও সমস্যা হয়?উফফ.!

--না,অামিনা....

অাসলে অামি তো......

অামি তো সাপকে কিছু দিয়ে বাড়ি মারি নি।

কাঁচুমাচু হয়ে বললেন উনি।

--তাহলে?কি বলছেন এসব অাবল তাবল?সাপ দেখে মাথা

কাজ করছে না?অাপনি এত ভীতু!

--না না,অাগে তো কথাটা শুনবে তুমি।হটাৎ অামার ঘুম

ভেঙে গেলো,পাশে দেখি তুমি নেই।ওটা শুয়ে অাছে,তো

অামি....

--ওটা!!মানে সাপ?তার মানে ওটা জ্বীন ই

ছিলো,ইন্নালিল্লাহ.....

--এই,ওয়াশরুমে কেন বলছ এসব?গুনাহ হলে?

--অাপনি জ্বিনটাকে কেন মারলেন অাগে সেটা বলুন!

যদি গুনাহ হয়?কেন এ.....

--অারে অারে অাহলিয়া,শুনবে তো!

অামি সাপটাকে কিভাবে মারব বলো?সাপটা তো

দেখ,এই যে,এই....

উনি ফোন থেকে অামাকে একটা সাপের ছবি দেখালেন।

অন্য সময় হলে অামার মাঝে কেমন প্রতিক্রিয়া হতো কে

জানে,কিন্তু এই মুহূর্তে কপট রাগ নিয়ে অামি উনার

দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অাছি।

উনি কয়েক সেকেন্ড অামার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ

নামিয়ে নিলেন।কাঁচুমাচু হয়ে বললেন,

--তুমি রাগ করেছ?অামি তো মিথ্যা বলিনি বলো।সত্যি

সত্যিই দেখো কত বড় সাপ,এটা দেখেই তো গলা শুকিয়ে

গেছে।তাই ভয়ে চলে এসেছি।অাসলে অামি...

--ভয়ে চলে এসেছেন?

--না না,ভয় কেন পাব?অামি কি ভীতু নাকি?হাহ!

অামি তো এসেছি, একটা সুন্নাহ পালন করতে।একই পাত্র

থেকে পানি নিয়ে গোসল করা সুন্নাহ তো।

--তো অামি বের হওয়ার পর অাপনি গোসল করলেও তো

একই পাত্র ই থাকতো,তাইনা? এত নাটক করে অাসার কি

দরকার ছিল?তাছাড়া এটাচ বাথরুম।অাসার সময় কোন পা

দিয়ে এসেছেন কে জানে?দুঅাও পড়েন নাই।

ভ্রু নাচিয়ে বললাম অামি।

--অাচ্ছা,দাঁড়াও বের হয়ে যাই....

বলেই প্রথমে ডান পা,পরে বাম পা দিয়ে উনি বের হয়ে,

"গুফরনাকা অালহামদুলিল্লাহিল্লাযী অাযহাবা

অান্নিল অাযা ওয়া অা'ফানি" পড়লেন।তারপর,

"বিসমিল্লাহি অাল্লাহুম্মা ইন্নি অাউযুবিকা মিনাল

খুবুছি,ওয়াল খবাইছ" পড়ে প্রথমে বাম পা,পরে ডান পা

দিয়ে প্রবেশ করলেন।

--এবার হয়েছে অাহলিয়া?

--অাপনি বের হয়েও অাবার এলেন কেন?

--না,ভাবলাম অারকি,এসেই যখন পরেছি গোসলটা করেই

যাই,

দাঁত কেলিয়ে হাসছেন উনি।অামার প্রচণ্ড হাসি পেলেও

অামি ভ্রু কুঁচকে রেখেছিলাম।অামার তাকানো দেখেই

সম্ভবত উনি ঢোক গিললেন।চোখগুলো নিচু করে মুখ

কালো করে,

--ঠিক অাছে,চলে যাই

বলে উনি পিছন ফিরে তাকালেন।এবার অামি হেসে

ফেললাম।হাসতে হাসতে এবার অামার চোখে পানি চলে

অাসার উপক্রম।কোথায় যেন পড়েছিলাম,হুজুররা অনেক

রোমান্টিক হয়,অাসলেই তাই।

…………………………………

…………………………………

…………………………………

তাহাজ্জুদের পর উনি অামার পড়া নিলেন,উস্তাযার কাছ

থেকে তাজউইদ সঠিকভাবে পড়ছি কিনা দেখলেন।তারপর

ফজর পড়ে অামার কোলে মাথা রেখে সূরা ইয়াসিনের

প্রথম দশ অায়াত অর্থসহ নিজেও মুখস্থ করলেন,অামাকেও

মুখে মুখে পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে নিলেন।

তারপর রুটিন মত ঘর ঝাড়ু দিয়ে অামায় নাস্তা বানাতে

সাহায্য করছিলেন,এমন সময়ে মায়ের চিৎকার

চেঁচামেচিতে অামরা চমকে ওই ঘরে যাই।

--দেখো রূপা,ভালোয় ভালোয় বলছি,অনেক চাকরি

করেছ,অার করার প্রয়োজন নেই।তুমি দেখছি অামার

ছেলেটাকে দাইয়্যুস বানিয়ে ছাড়বে।কাল রাতে এত

বোঝানো সত্ত্বেও তুমি এখন সেজেগুঁজে অফিস যাচ্ছ?

জানো মুখ ঢাকা ফরজ যে?তোমার এই সাজগোঁজের জন্য

কত ছেলের চোখের যিনাহ হতে পারে,জানো?!

--মুখ ঢাকা ফরজ!! এসব উদ্ভট কথা কোথায় পান অাপনি?এই

অামিনা মেয়েটার সাথে থেকে থেকে অাপনার মাথা

গেছে বুঝলেন?অাপনার ছেলে নিজে তো জঙ্গি,মেয়ে

একটাকে কোথা থেকে খুঁজে এনেছে,সে অারেক

জঙ্গি,অসামাজিক একটা মেয়ে।এখন তারা অাপনার

মাথা খাচ্ছে।

--মাথা খাচ্ছে না বরং ওরা অামাকে সিরাতুল

মুস্তাক্বিম চেনাচ্ছে।মুখ ঢাকা ফরজ বুঝেছ?এটা

কুরঅানে অাছে।অামিনা,সেদিন না তালিমে এটা

বলেছিল।তুমি একটু বলো তো রূপাকে।কুরঅানে কোথায়

কোথায় মুখ ঢাকা ফরজ যে এটা অাছে?

অামি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম,

--অাপা,সূরা অাহযাবে.....

--শাট অাপ ইউ ইলিটারেট গার্ল।কয়বার বলব অামাকে

অাপা না বলতে?অার সূরা ক্বিরাত কি অামাকে তোমার

কাছ থেকে শেখা লাগবে নাকি?লিসেন,অামি যথেষ্ট

জানি ইসলাম নিয়ে,অার সেটা মানি ও।তুমি নিজের

চরকায় তেল দাও,বুঝেছ?কোথা থেকে তুলে এনেছে কে

জানে?ম্যানার বলতে কিছু নেই এই মেয়ের মাঝে।অারে

এর চেয়ে তো পাশের বাড়ির.....

ঠাশ!!

হটাৎ কি হলো কে জানে!অামার শ্বাশুড়ি মা বড় জায়ের

মুখে চড় মেরে দিলেন।এতক্ষণ শায়খ চোখ নিচু করে

ছিলেন,এই প্রথম চোখ তুলে তাকালেন।ঘটনা বুঝেই

অামার শায়খ তড়িঘড়ি করে এসে মাকে সামলালেন।

চেয়ারে বসিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়ালেন।বড় জা

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন।পরে রাগত স্বরে

মাকে এসে বললেন,

--অাপনি হয়ত ভুলে গেছেন দেশে অাইন অাছে।অামি

অাজকেই গৃহবধূ নির্যাতনের জন্য মামলা দায়ের করব।

অামার জীবন,অামি কিভাবে কাটাবো অামার ইচ্ছা!

অাপনি বলার কে?

কদিন অাগেও তো শবে বরাত শবে কদর ছাড়া নামায

পড়তেন না।এখন খুবই সূফী সাজছেন দেখি!অবশ্য এখন তো

বয়স হয়েছে তাইনা?এক পা কবরে,অারেক পা

মাটিতে,তাই এত ধর্মকর্ম করছেন।অামার সময় হলে

অামিও করব,অাপনাদের শিখিয়ে দেওয়া লাগবে না।

অার এই মিডল ক্লাস মেয়েটার জন্য অামার গায়ে হাত

তুললেন না?এর বদলা তো অামি নিব ই।মনে

রাখবেন,সংসারের অর্ধেক খরচ কিন্তু অামার অার

অাপনার বড় ছেলের পকেট থেকেই অাসে।

বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন তিনি।

অামার শায়খ মাকে তেলে বেগুণে জ্বলে উঠতে দেখে

সবর করতে বললেন।বলতে থাকলেন,

--মা,তুমি উনার মুখে অাঘাত করলে কেন?এটা গুনাহ না?

--রাগে করছি,বেটা,রাগে করছি।এখন কি করতে হবে বল?

ওর পা ধরে মাফ চাইবো?

--এখনও রেগে অাছ তুমি?মা!

জানো হাদিসে কি এসেছে?প্রকৃত বীরপুরুষ সে,যে

রাগের সময় নিজেকে কন্ট্রোল করে।

--ওখানে পুরুষের কথা বলছে,অামি পুরুষ না।

মায়ের কথায় ফিক করে হেসে দিলেন উনি।মায়ের হাত

জড়িয়ে বললেন,

--তুমি হলে বীর নারী, বুঝলে?এখন শুনো,ভাবির গায়ে হাত

তুললে কেন?

--ও তোর বউয়ের সাথে এভাবে কথা বলছিল কেন?

--তাতে কি হয়েছে?অামিনাকে তো তুমি ভালবাসো

না,ছেলের বউ হিসেবে মানো না,তুমিই তো বলেছিলে।

তাহলে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করলে কি এমন হবে?

--থাপ্পড় কি এখন তুই খাবি?কখন কি বলেছি এখনও সেসব

নিয়ে পড়ে অাছিস কেন?এই মেয়ে,এদিকে এসো,কোন

কোন সূরায় মুখ ঢাকা নিয়ে বলেছে অামার বেটা সেগুলো

বলবে,তুমি খাতা কলম নাও।তাড়াতাড়ি করো,লিখো

এবার।

--

১.সূরা অাহযাবের ৫৯ নং অায়াতে অাছে,

"হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে,কন্যা

গণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে

বলুন,তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ

নিজদের উপর টেনে দেয়,এতে তাদের

চেনা সহজ হবে,ফলে তাদের উত্যক্ত করা

হবে না,আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু!"

এই আয়াতে স্পষ্ট ভাবে চেহারার পর্দার

কথা বলা হয়েছে,

'চাদরের কিয়দাংশ নিজের উপর টেনে

দেয়'

বাক্যটিই প্রমান করে এখানে

গায়ের চাদরের কিছু অংশ মুখের উপর

টেনে দেয়ার কথা বলা হয়েছে......

২.সূরা অান নূরের ৩১ নং অায়াতে অাছে,

".... তারা যেন যা সাধারনত প্রকাশ্যমান

তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না

করে..."

এই আয়াতটির ভুল ব্যাখ্যা করে অনেকে মুখ

খোলা রাখার ব্যাপারে যুক্তি

দেখান,কারন এখানে বলা হয়েছে যা

সাধারনত প্রকাশমান!

সুতরাং তারা চেহারা কে প্রকাশ্য বস্তু

ধরে নিয়েছে!

অথচ যা দৃশ্যত প্রকাশমান বলতে নারীর

দৈর্ঘ ও খর্বতা,কৃশতা ও স্থুলতা,বাতাসের

দোলে বোরকার নিচের পোশাক বা

দেহের কোন অংশ দেখা যাওয়া কে

বুঝানো হয়েছে,

অর্থাৎ নারীর সৌন্দর্যের কোন কিছু অনিচ্ছায়

প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি পর্দার হুকুম থেকে বিযোজ্য।

সেজন্যই উক্ত আয়াতে আল্লাহ 'নারী

নিজে যা প্রকাশ করে' কথাটি বলেননি।বলেছেন, যে

সৌন্দর্য নারীর স্বেচ্ছা

সম্পাদন ব্যতীত এমনিতেই প্রকাশিত হয়ে যায়।

সুতরাং হাত,মুখ,পা এগুলোও পর্দার

অন্তর্ভুক্ত..

৩.সূরা নূরের ৩০ নং অায়াতে অাছে,

"মুমিনদের বলুন,তারা যেন তাদের দৃষ্টি কে

নত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হিফাযত

করে,এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা

আছে,নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা

অবহিত আছেন।"

প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তিই বুঝবে এই আয়াতে কি

বুঝানো হয়েছে..

নারীর চেহারা পর্দামুক্ত রাখার অর্থই হল তারা যেন

পুরুষদেরকে তাদের দেখার

প্রতি আমন্ত্রন জানাচ্ছে।

৪.সূরা নূরের ৩১ নং অায়াতে অাছে,

"ঈমানদার নারীদের বলুন,তারা যেন

তাদের দৃষ্টি কে নত রাখে এবং তাদের

লজ্জাস্থানের হিফাযত করে,এবং

সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।"

প্রথমে পুরুষদের দৃষ্টি নত রাখতে বলা হয়েছে,পরবর্তী

আয়াতেই নারীর সৌন্দর্য

প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে...

মানে কি দাঁড়াল?

আপনি সৌন্দর্য প্রদর্শন করলে পুরুষ রা তাকাবেই,তাই

নারীর পর্দা পুরুষদেরকে তাদের দৃষ্টি অবনত রাখতে

সাহায্য করবে...

৫.এবং সূরা নূরে অারও অাছে,

"তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা

প্রকাশের জন্য জোরে পদচারণা না করে।"

নারীর জন্য পায়েল বা নুপুরের শব্দ নিয়ে ঘর থেকে বের

হওয়া হারাম, নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ পুরুষের মনে

ফিতনার উদ্রেগ ঘটাতে পারে, নারীর জন্য যেহেতু শব্দ

তোলে এমন কিছু

পরিধান করার বৈধতা টুকুও নেই,

তাহলে চেহারা খোলা রাখা বৈধ হয় কিভাবে?

৬.সূরা অাহযাবের ৩৩ নং অায়াতে অাছে,

"তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান

করবে,মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে

প্রদর্শন করবেনা....."

যদিও জাহিলী যুগের নারীরা অধুনা বিশ্বের নারীদের

মত বাহু,কাঁধ,বক্ষ, পিঠ,উরু উন্মুক্ত করে চলত না,

তারা কেবল চেহারা খোলা রাখত,বড়জোর চুল বের করে

চলত।

তদুপরি অজ্ঞতার যুগের অধিকাংশ নারীই চেহারা

পর্দাবৃত রাখত,সেকালের কাব্য সাহিত্য থেকে এমনটিই

জানা যায়।

এরপরও আল্লাহ ইরশাদ করেন 'অজ্ঞতা

যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না'।

৭.সূরা অাহযাবের ৫৩ নং অায়াতে অাছে,

"তোমরা তার (নবী) পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার

আড়াল থেকে চাইবে,

এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাদের অন্তরের জন্য

অধিকতর পবিত্রতার কারন!"

(সূরা আহযাবঃ৫৩)

আয়াত টি চেহারার পর্দার আবশ্যিকতার ব্যাপারে

সুস্পষ্ট দলিল।

এখানে নবী পত্নীদের সম্মোধন করা হলেও তা উম্মতের

জন্য ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য.......

.

লিখা শেষ করে খাতাটা বাড়িয়ে দিলাম মাকে।মা

হটাৎই শায়খকে বলে উঠলেন,

--বেটা,অামায় এক জোড়া হাত মোজা অার এক জোড়া

পায়ের মোজা এনে দিবি বেতন পেলে?

অামার শায়খ চমকে মায়ের দিকে তাকালেন।অামি

জানি অামার শায়খ এখন কেঁদে ফেলবেন।মায়ের এমন

বদলে যাওয়া রূপ তো তিনি অাগে দেখেন নি।

ইনশাআল্লাহ চলবে........






"শায়খ"

পর্ব তেরো.......

মা বড় ভাইকে পুরোদমে চাপ দিচ্ছেন বড় জায়ের জন্য

অালাদা বাড়ির ব্যবস্থা করতে,পাশাপাশি চাকরি

ছাড়াতে।বড় ভাইয়া অার জা মানতে নারাজ।প্রতিনিয়ত

তুমুল ঝগড়াঝাঁটি,এক পর্যায়ে বড় ভাইয়া অাপাকে নিয়ে

অালাদা হয়ে গেছে।মা এখন অামাদের সাথেই থাকে।

এক দেওরের বিয়ের কথা চলছে এখন।অাগের মা অার

এখনকার মায়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য।মা কেবলমাত্র

পর্দানশীন মেয়ে খুঁজছেন।অন্যদিকে দেওরের পছন্দ করা

জাহেলিয়াতে ডুবন্ত একজন মেয়ে অাছে,সামিয়া।দেও

রের সাথেও কথা কাটাকাটি হতে থাকলো মায়ের।

সেদিন হুট করেই অামায় জিজ্ঞাসা করলেন,

--সামিয়ার সাথে অামার ছেলেটার বিয়ে দিয়ে যদি

মেয়েটাকে প্রতিদিন দাওয়াত দিই,তাহলে কি

মেয়েটাও তোমার মত হয়ে যাবে?

--মা,হিদায়াত অাল্লাহর তরফ থেকে অাসে।অামরা শুধু

চেষ্টা করতে পারি।তবে অামার মনে হয়,ওদের বিয়েটা

না দিলে অবিচার হবে।

--কেন?অামার ছেলের জন্য একজন ধার্মিক মেয়ে অামি

খুঁজতেই পারি।অামার কি অতটুকুও অধিকার নেই?

--ভূল বুঝবেন না মা।অধিকার অবশ্যই অাছে।তবে ওর

বিয়ের ব্যাপারে ও বেশী হক্বদার।ওর পূর্ণ অধিকার

অাছে পছন্দমত বিয়ে করার।তাছাড়া ওদের এতদিনের

সম্পর্ক,বিয়ে না হলে ওদের মনের যিনাহ হতে পারে

মা,এবং এটা চলতেও পারে....

--কিন্তু মেয়ে তো জাহেল।

--ছেলেও তো জাহেল।

--ঠিক বলছো।তবুও....

অাচ্ছা,কয়েকটা শর্ত দিই ওদেরকে?যেমন কম

দেনমোহর,মাসজিদে বিয়ে,পর্দার সুব্যবস্থা.....

এগুলো।তারপর অাস্তে অাস্তে অামরা ঠিক করে নিব,কি

বলো?

--হ্যাঁ অাম্মা এটা করতে পারেন।

শাশুড়ি মা দেওর অার সামিয়াকে শর্তগুলোর কথা

বললেন।অনেক অালাপচারিতার পর সিদ্ধান্ত হলো মোহর

কমপক্ষে এক লাখ টাকা হবে,অার ঘরোয়াভাবে বিয়ে

হবে।

বিয়েটা হয়ে গেলো।মা অামার ছোট জাকে প্রতিনিয়ত

দাওয়াত দিচ্ছিলেন।এক প্রকার জোর করেই নামায

পড়াতেন,তালিমে নিয়ে যেতেন।সামিয়া নামাযটা

রেগুলার পড়লেও অন্যান্য অানুসাঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে

সচেতন না।তালিমের অান্টিটা মায়ের অনুরোধে

প্রতিদিন এখন রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি ওয়া

সাল্লাম অার অাম্মাজানদের মাঝের সম্পর্ক নিয়ে

অালোচনা করেন।সংসার জীবন কিভাবে ছোট্ট একটা

জান্নাতে পরিণত করা যায়,সেসব নিয়ে অালোচনা

করছেন।সামিয়া একটু একটু ইন্সপায়ার হচ্ছে বোঝা যায়।

পাশাপাশি অামি বুঝতে পারলাম অামার মাঝে অন্য

কারও অস্তিত্ব।লজ্জায় একাকার হয়ে যাচ্ছি। সম্ভবত

নিজের মাঝে ছোট্ট কারও অনুভূতির চাইতে অসম্ভব

ভালোলাগার অার কোনও অনুভূতি পৃথিবীতে অাছে বলে

মনে হয়না।শায়খকে যখন জানালাম,চিৎকার করে

তাকবির দিয়ে সাজদায় পড়ে গেলেন।অশ্রু ধোয়া মুখ,অথচ

মুখে চওড়া হাসি,অামি অাবারও উনার প্রেমে পরে

গেলাম।শাশুড়ি মা তো কাঁথা সেলাই করতেই ব্যস্ত।

অামিও কম যাই নাকি,ফেসবুকে পড়েছি এই সময় কুরঅান

খতম দিলে সন্তান জান্নাতি হয়,কোন মাসে কি সূরা

পড়ব সব,নোট করে রেখেছি।একদিন হটাৎই শায়খ নোটবুক

দেখে বললেন,এসব নাকি বানোয়াট।সহীহ হাদিসে এই

সময়কার এসব অামলের কথা নেই।কি অদ্ভুত!মানুষ জাল

হাদিস ও বানায়!!!!

প্রতি মাসে মাসে চেকাপ চললেও অামার কেবল ভয় হতো

সব ঠিকঠাক থাকবে তো?অামি ওই ছোট্ট হাতপা গুলোকে

ছুঁয়ে ছুঁয়ে অাদর করতে পারব তো?অাসলে এই অনুভূতিটা

কেমন যেন,ভয়,সাবধানতা

,অানন্দ,ব্যাথা,সব একসাথে......

দিন যতই কাছে অাসছে,স্বলাত অাদায় করতে অামার

ততই কষ্ট হচ্ছে।তারপরও ধৈর্য ধরে স্বলাত পরতাম।কোথা

থেকে শাশুড়ি মা মারয়াম ফুল এনে জমা করলেন।শায়খ

মাকে বুঝিয়ে বললেন,এই ফুলের উপর নির্ভরতার কারণে

শিরকী গুনাহও হয়ে যেতে পারে।

দিন ঘনিয়ে অাসছিলো অার অামার শায়খের অস্থিরতা

বাড়ছিল।এক পর্যায়ে অামার ব্যাথা শুরু হলো,উনি

পাগলপ্রায় হয়ে অামায় মেডিকেলে নিয়ে গেলেন।

সিজারিয়ান ডেলিভারি কোনও ভাবেই হতে দিবেন না

জানিয় রেখেছেন ডাক্তার অাপুকে।সম্পূর্ণ সময় অামার

হাত ধরে অামার সাথে থাকার জন্য প্রচুর জেদ

করেছিলেন তিনি।কিন্তু রুলসের বাইরে হওয়ায় পারেন

নি।পুরোটা সময় কেমন গিয়েছিল,তা লিখে প্রকাশ করা

যাবেনা।একদিকে ডাক্তার অাপার ভয়ার্ত কণ্ঠে "পুশ

অামিনা,পুশ" অাদেশ,অন্যদিকে চূড়ান্ত কষ্ট।

হটাৎই কান্নার শব্দ........

এতটা কষ্টের পর এই অল্প একটুখানি কান্না শোনার

অনুভূতি বর্ণনা করার সাধ্য পৃথিবীর কোনও কবি-

সাহিত্যিকের নেই,থাকা সম্ভব না।

ইনশাআল্লাহ চলবে.....




"শায়খ"

পর্ব চৌদ্দ....

ছোট্ট একটা বাবু......

অামার সামনে যখন বাবুটাকে অানা হলো তখন প্রায়

ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে।এতক্ষণ ঠিক কি হয়েছে তা

অামার মনে নেই।ছোট্ট বাবুটাকে দেখার পর কি করা

উচিৎ তাও বুঝতে পারছিনা।কোনও মতে বুকে জড়িয়ে

কেঁদে ফেললাম।

মন ভরে দেখছিলাম অামার ছোট্ট সোনামনি টাকে।

ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা,কি ছোট্ট দুটো চোখ,চুলগুলো কি

সুন্দর,কি মায়া.....

মাশাঅাল্লাহ!মাশাঅাল্লাহ!

উফফ!এত ছোট্ট বাবুটা অামার,অামি ই বাবুটার মা।

এতগুলো দিন ধরে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছিলো

অামার মাঝে.....

অামার কান্না থামছিলো না।বিয়ের দিন যখন কবুল

বলেছিলাম,তখন ভেবেছিলাম বিয়ের চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত

অার নেই।যখন প্রথম প্রথম ফিল করতাম অামার মাঝে,তখন

ভেবেছিলাম মা হওয়ার চাইতে সুন্দর অনুভূতি অার নেই।

কিন্তু যখন বাবুটাকে হাতে নিলাম,বুঝতে পারলাম

অাসলে সবচাইতে সুন্দর,সবচাইতে অানন্দদায়ক মুহূর্ত কি

হতে পারে।বাবুটা কাঁদছে,অার অামার মনে হচ্ছে,সে

যেন অামাকে 'মা,মা' বলে ডাকছে।অামি পাগলের মতন

চুমু খেলাম,ওর হাতগুলো,পা,মুখে,সারা শরীরে হাত

বুলিয়ে দিলাম,জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললাম

অাবারও।

অামার রব্ব কত দয়ালু,অামার মহামহিম রব্বের কত

করূণা,অামায় এই ছোট্ট বাবুটা উপহার দিয়েছেন তিনি।

কৃতজ্ঞতায় চোখ অারও ভারী হয়ে উঠছিলো,অামি

বিড়বিড় করে পড়লাম,অালহামদুলিল্লাহ।

শায়খ অামার পাশে বসা।অামার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব

স্নেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

--কষ্ট হচ্ছে অাহলিয়া?

অামি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম,হচ্ছে না।

--জানো,বাবুকে খেঁজুর খওয়ানোর সময় যা তুলকালাম

কাণ্ড হলো,ডাক্তার অাপা কিছুতেই বাবুকে খেঁজুর

খাওয়াতে দিবেন না।অথচ চিন্তা করো, খেজুর দিয়ে

তাহনিক করা সুন্নত।

--তাহনিক মানে?

--তাহনিক বলতে,খেঁজুর চিবিয়ে নবজাতকের মুখের

তালুতে আলতোভাবে মালিশ করা এবং তার মুখ খুলে

দেয়া যাতে তার পেটে এর কিছু অংশ প্রবেশ করে।

--কিন্তু অামি তো শুনেছি এটা মুস্তাহাব।

--হ্যাঁ,ঠিকই শুনেছ।সকল অালেম একমত হয়েছেন,এটা

মুস্তাহাব।কিন্তু রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি ওয়া

সাল্লাম যেহেতু এটা করেছেন,এবং তার সব কাজকেই

সুন্নাহ বলা হয়,তাই তাহনিক করাকেও সুন্নাহ বলা

যায়,বুঝলে?

--হু,বুঝলাম।তো পরে বাবুকে তাহনিক করিয়েছ?অার

কানে অাযান দিয়েছ?

--হ্যাঁ করেছি।ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত

দিয়েছি মৃদু আওয়াজে......

এখন এত কথা না বলে বাবুকে খাইয়ে দাও তো।তোমারও

নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?কত বেলা হলো দেখেছ?

--অাপনি খেয়েছেন?

--জ্বি না,অামার অাহলিয়া এমন পরিস্থিতির মাঝে,অার

অামি খেয়ে বসে থাকব,এমন কঠিন হৃদয় অামার নেই।

অামি বাবুটাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলাম,হুট করে

শায়খ এসে অামার কপালে চুমু খেলেন।উনার চোখে

অশ্রু,মুখে প্রশস্ত হাসি...................

হাসপাতাল থেকে পরদিনই চলে এলাম।অামার ছোট জা

এক প্রকার জোর করেই অামার বালিশের নিচে রসুনের

কোয়া,দেশলাইকাঠি,লোহার টুকরা রাখা শুরু করলো।

অামি কিছুই না বুঝে জিজ্ঞেস করলাম,

--এসব কেন সামিয়া?

--অাপা,অাপনি জানেন না,এই সময় শয়তান অাসে বাবুকে

নিয়ে যেতে,এসব রাখলে শয়তান অার অাসার সুযোগ

পায়না।

--কে বললো শায়ত্বান অাসে?অার অাসলেও কি?

প্রতিদিন অায়াতুল কুরসি পড়ে দিবে,বাবুর কাছে এসে

কুরঅান শরীফ পড়বে,তাহলেই হবে ইনশাআল্লাহ।এসব কিছু

কুসংস্কার,বুঝেছ?

--কিন্তু সবাই তো এসব মানে....

--এসব তো কুরঅান-হাদিসে নেই সাইমা।তাই এসব বর্জন

করতে হবে,বুঝেছ?তাছাড়

া এসবের কোনও ভিত্তিও নেই।

--তাহলে কি এসব সরিয়ে ফেলব?ইয়া অাল্লাহ!কি

করেছেন অাপা?কপালে একটা টিপ দিবেন না?জানেন

না সবাই নজর দেয়?দাঁড়ান অামি কাজল অানি।সবসময়

কাজল দিয়ে বা কপালে টিপ দিয়ে রাখবেন।

--দাঁড়াও সামিয়া,

বলে হাত ধরে টেনে বসালাম ওকে।

এটাও কুসংস্কার।টিপ থাকলে কারও বদনজর

লাগবেনা,এমন বিশ্বাস করলে সেটা শিরক হয়ে যেতে

পারে,বুঝেছ?

--তাহলে সবাই যে লাগায়?

--কি জানি কেন লাগায়,তবে অামরা কালো টিপ দিবো

না বাবুর কপালে,কেমন?

--তাহলে যদি নজর লাগে?কি করব?সেদিন না তালিমের

অান্টিটা বলেছেন,বদনজর কাউকে কবর পর্যন্তও নিয়ে

যায়!যদি বাবুর উপর কারও নজর লাগে?

--তাহলে রুকইয়াহ করে নিব।রুকইয়াহ অাছে না?শরীয়ত

সম্মত ঝাঁড়ফুক!

--কিন্তু সেটা তো নজর লাগার পর,নজর যাতে না লাগে

তার জন্য কিছু করা যায় না?

--হু যায় তো।একটা হাদিসে এসেছে এমন,

রসূলুল্লাহ হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি.-এর জন্য এই দোয়া

পড়ে আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।

ﺃُﻋِﻴْﺬُﻛُﻤَﺎ ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎﺕِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺍﻟﺘَّﺎﻣَّﺔِ ﻣِﻦْ ﻛُﻞِّ ﺷَﻴْﻄَﺎﻥٍ ﻭَّﻫَﺎﻣَّﺔٍ ﻭَّﻣِﻦْ ﻛُﻞِّ ﻋَﻴْﻦٍ ﻻَﻣَّﺔٍ

অর্থাৎ সকল শয়তান, কীটপতঙ্গ ও বদনজর হতে

তোমাদেরকে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালেমাসমূহের আশ্রয়ে

দিচ্ছি।

দোয়াটি এক সন্তানের জন্য পড়লে ‘উয়িযুকা’, দুইজনের

জন্য ‘উয়িযুকুমা’ আর দুইয়ের অধিক হলে ‘উয়িযুকুম’ বলতে

হবে।

এর সঙ্গে আয়াতুল কুরসি, তিন কুল ও হাদিসের অন্যান্য

দোয়া তো আছেই।

--তাহলে অামিও প্রতিদিন দুঅাটা পড়ে দিব কেমন?

অার অাক্বিকা কবে দিবেন অাপা?

--সাতদিন হলেই ইনশাআল্লাহ।

--নাম ঠিক করছেন বাবুর?নাকি সেদিনই রাখবেন?

অামি কিচ্ছু বলিনি অার,মুচকি হেসে বাবুটাকে বুকে

জড়িয়ে নিয়েছি।

বাবুটা শান্ত হয়ে অাছে।অামার ছোট্ট সোনাটার নাম

তো অামি সেই কিশোরী থাকার সময় থেকেই ঠিক করে

নিয়েছি।

মুহাম্মাদ,অামার মুহাম্মাদ.............

ইনশাআল্লাহ চলবে....

Sunday 18 November 2018

কালো মেয়ে শিক্ষামূলক গল্প


১.
ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে গত সপ্তাহ থেকে। কিন্তু অসুস্থ থাকায় ক্লাসে যেতে পারেনি তুবা। সে হিসেবে আজকেই ভার্সিটিতে ওর প্রথম দিন। বেশ ব্রাইট মেকাপ করে আজ ভার্সিটিতে এসেছে তুবা। চেহারার অনুজ্জ্বলতা ঢাকতে বরাবরই খুব সতর্ক সে। ভার্সিটিতে এসেই তুবার চোখ লিজা আর মারিয়াকে খুঁজে ফিরছে। ওরা দুজনেই তুবার কলেজফ্রেন্ড।
মারিয়াকে ফোন করল তুবা,
-হ্যা রে, কই তুই?
-এইতো ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকলাম কেবল।
-আমি ক্লাসে আছি, চলে আয়।
-আমাদের ক্লাস কোন বিল্ডিং-এ?
-গেট থেকে সোজা এসে ডান দিকের বিল্ডিং এর দোতলায়। চলে আয় তাড়াতাড়ি।
-হ্যা আসছি।
বলে ফোন কেটে ক্লাসের দিকে গেলো তুবা।
ক্লাসে গিয়ে মারিয়ার পাশের সিটে বসলো। পুরো ভার্সিটিতে সব স্টুডেন্টসই তার অচেনা। শুধু মারিয়া আর লিজাই পরিচিত। মারিয়া আর তুবা একই ডিপার্টমেন্টে কিন্তু লিজাটা অন্য ডিপার্টমেন্টে।
বসে সামনেপিছনে দেখতে লাগলো তুবা। সবাই একে অপরের সাথে গল্পগুজবে ব্যস্ত। বেশ কোলাহলপূর্ণ রুমটা।
মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
-কী রে? কী দেখছিস?
-দেখছি, আমাদের ক্লাসে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে!
- এতে আশ্চার্য হওয়ার কিছুই নেই। আমাদের ডিপার্টমেন্টে কোনো ছেলে নেই বুঝলি?সুতরাং মেয়েই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
-আরে, ঐ ডান দিকের মেয়েটাকে দেখ, কী ফর্সা আর কী সুন্দর! ওর পিছনের মেয়েটাও অনেক ফর্সা। তোর মতো সুন্দর।
-তোর কি মাথায় সারাদিন খালি সৌন্দর্যতত্ত্বই ঘোরে?
-আমি নিজে কালো তো তাই সৌন্দর্যের প্রতি আমার একটু বেশিই দুর্বলতা। হিহিহি...
হেসে উত্তর দিলো তুবা।
-দেখ তুবা, তুই কালো না। শ্যামলা। আর তোর ফেস কাটিং অনেক ফর্সা মেয়ের থেকেও সুন্দর। আর আজকে তুই কত সুন্দর করে সেজে এসেছিস। দারুণ লাগছে তোকে!
-হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবে না।
-মিথ্যে কেন বলবো? তুই তো এমনিতে সুন্দরই। শুধু গায়ের রঙটা একটু চাপা।
-ওই হলো। তোর মতো ফর্সা তো আর নই। আর মেকাপ ছাড়া তো সবাই কালোই বলে...
বলেই মুখটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেলো তুবার...
মারিয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো এরই মধ্যে একজন ম্যাম ঢুকলেন ক্লাসে। গল্পগুজব বন্ধ হয়ে সবার কনসার্ন সেদিকে গেলো।
ম্যাম এর দিকে তাকিয়ে তুবার চোখ তো ছানাবড়া! এত্ত সুন্দরও কি মানুষ হয়! নীল রঙের শাড়িতে ম্যামকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কী ফর্সা গায়ের রঙ! হাতগুলো দেখলে মনে হয় যেন মোমের তৈরি!
একটু কালো বা শ্যামবর্ণের মেয়েগুলো বোধহয় এমনই হয়। মুখে যতো যাই বলুক না কেন, ভেতরে ভেতরে ঠিকই সুন্দরী বা ফর্সা কাউকে দেখলে মনের মধ্যে একটু আক্ষেপ জন্ম নেয়। নিজের প্রতি বিদ্বেষ বাসা বাঁধে। আমি কেন ওরকম নই। তুবাও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অন্যদের থেকে একটু বেশিই আক্ষেপ তার মনে। এমনিতে সে শ্যামবর্ণা, তবে খুব স্মার্ট এবং মেধাবীও। কিন্তু আমাদের ঘুণেধরা সমাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদেরকে বিচার করে সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। আবার সেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ণীত হয় চামড়ার উজ্জলতার ভিত্ততে। সেই হিসেবে তুবার মনে নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ জন্মানোটাই স্বাভাবিক।
ম্যাম স্ট্রিক দিয়ে প্রজেক্টরে দেখাচ্ছেন আর লেকচার দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তিনি তুবাকে লক্ষ্য করে বললেন,
-ইউ গার্ল! স্ট্যান্ড আপ।
তুবা দাঁড়িয়ে বলল,
-ইয়েস ম্যাম
-তুমি কি আজ নতুন?
-জি ম্যাম।
-এ কয়দিন আসোনি কেন?
-আমি অসুস্থ ছিলাম ম্যাম।
-ওহ আচ্ছা। বসতে পারো।
বলে, আবার বোর্ডের কাছে গেলেন ম্যাম। কী ভেবেই আবার ঘুরে বললেন,
-শোনো!
বসতে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়িয়ে তুবা বলল,
-জি ম্যাম
তুবার আপাদমস্তক একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে ম্যাম বললেন,
-শোনো মেয়ে, এটা ক্লাস রুম। বিউটি কাম্পিটিশান স্টেইজ না। এতো মেকাপ নিয়েছো কেন?
ম্যামের কথায় বেশ থতমত খেয়ে যায় তুবা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটা। ম্যাম আবার বললেন,
-তারুণ্যের বয়স তোমাদের, মেকাপ একটুআধটু করতেই পারো কিন্তু, কালো মেয়েরা এতো মেকাপ করলে দেখতে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে। ড্রেসাপ তো বেশ স্মার্ট। এটুকুও বোঝো না? সুন্দর সাজতে গিয়ে ভুতের মতো লাগলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী লাগে, বুঝেছো?
ম্যামের কথা শুনে ক্লাসের সব মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো। ম্যামের তিরস্কার শুনে লজ্জায় অপমানে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তুবা। সবার বিদ্রুপাত্মক হাসি শুনেও সেদিকে তাকানোর সাহস হলো না মেয়েটার। অপমানবোধে কান্না চলে আসছিলো। নেহাত ক্লাস বলেই কোনওমতে কান্না চেপে, মৃদু কণ্ঠে বলল,
-জি ম্যাম।
-ঠিক আছে, বসতে পারো



"কালো মেয়ে"
পর্ব ২ঃ
চেহারায় কিছুটা বিরক্তিভাব প্রকাশ করে, ম্যাম আবার পড়ানোয় মনোনিবেশ করলেন। ক্লাসের বাকিটা সময় মাথা নিচু করে বসে থাকলো তুবা। ক্লাসের সময় শেষ হলে, ম্যাম চলে গেলেন। এরপর সবাই আবার যে যার মতো গল্পগুজবে মেতে উঠলো। তুবার বেঞ্চের আশেপাশের কয়েকটা মেয়ে তুবার দিকে তাকাচ্ছে আর ম্যামের করা মন্তব্য নিয়ে কানাঘুষো আর হাসাহাসি করছে একে অপরের সাথে। ব্যাপারটা যেন কাটা ঘায়ে নুনেরছিটের মতো বিঁধছে ওর মনে।
তুবা মাথানিচু করে চুপচাপ বসে আছে দেখে মারিয়া বলল,
-মন খারাপ করিস না তুবা। এই ম্যামটা এমনই। উনি অন্য আরেক স্যারের পরিবর্তে এযাবৎ চারটা ক্লাস নিলেন, প্রত্যেক ক্লাসেই কাউকে না কাউকে অযথা কথা শুনিয়েছেন।
-তুই ই বল মারিয়া, আমি কি ভুতের মতো মেকাপ নিয়েছি? এতগুলো মেয়ের সামনে আমাকে কীসব যা তা বলে অপমান করলো!
-না। বাদ দে তো মন খারাপ করিস না।
-আসলে সমস্যা আমার মেকাপে না। সমস্যা হচ্ছে আমার গায়ের রঙে। আমি কালো তো। কালো হয়ে জন্মানোটাই বোধহয় জগতের সবথেকে বড় পাপ!
মারিয়া কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সত্যিইতো শ্যামলা বা কালো মানুষগুলোর প্রতি, ফর্সা মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিটাই এমন বিদঘুটে যে, তারা যেন মানুষই না। উজ্জল গায়ের রঙেই যেন সব শ্রেষ্ঠত্ব।
-আমার ভালো লাগছে না মারিয়া। আজ আর ক্লাস করবো না বাসায় চলে যাচ্ছি;
-চলে যাবি? আজতো বেশি ক্লাস হবে না। আর তো একটা ক্লাস আছে। শেষ করে যা।
-নাহ। ভালো লাগছে না।
বলে উঠে চলে গেল তুবা।
ম্যামের কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। অবশ্য কারো গায়ের রঙ কালো হলে এরকম কষ্ট আর তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। তুবা যদিও একেবারে কালো নয়। শ্যমবর্ণের। কিন্তু রঙটা চাপা। তাই কালোই বলে অনেকে।
তুবারা দুই ভাইবোন। তুবার মা যদিও বেশ ফর্সা কিন্তু ওর বাবা কালো। ছেলে মেয়ে দুজনে বাবা মায়ের মাঝামাঝি রঙ পেয়েছে। তবে ছেলেরা শ্যামলা বা তার থেকেও একটু ডার্ক, যাই হোক না কেন, এমনকি কালো হলেও সমাজের খুব বেশি যায় আসে না। ভালো সার্টিফিকেট আর ভালো চাকরিবাকরি থাকলেই, কালো ছেলেও হয়ে যায় রাজপুত্র। বিয়ের ক্ষেতেও তেমন সমস্যা হয় না তাদের। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি একটু অনুজ্জ্বল শ্যামলা হয় তাহলেই যেন সে অসুন্দরের প্রতীক। আর কালো হলে তো কথাই নেই। যতোই যোগ্য, গুণবতী বা দ্বীনদারই হোক না কেন, সমাজের চোখে তারা দ্বিতীয় শ্রেনির মানুষ। বিয়ের ক্ষেত্রেও যেন তারা একেবারে অচ্ছুত! এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু জেনারেল পরিবারগুলোতেই নয়, দ্বীনি পরিবারগুলোতেও বিয়ের জন্য প্রথম রিকোয়ারমেন্ট হয় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা! অবশ্য এই সুন্দরীর মাপকাঠি যে "সাদাচামড়া" সে আর বলাই বাহুল্য। আমাদের সমাজের এই বর্ণবাদী ধ্যানধারণা যে কত সুস্থ মানুষের জীবনকেও বিষয়ে তুলছে তা যদি এই সমাজ বুঝতো!
বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো তুবা। ফ্রেশ হয়ে এসে, বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। কিছুটা হালকা লাগছে এখন। ম্যামের বলা কথাগুলো আর ক্লাসের মেয়েদের বিদ্রুপাত্মক হাসির কথা মনে পড়তেই মনটা আবারও বিষাদে ছেয়ে যায় তুবার। মা এসে জিজ্ঞেস করল,
-কী রে মা মন খারাপ নাকি?
-না আম্মু, কিছু না।
-আচ্ছা তাহলে রেস্ট নে।
বলে চলে গেলেন, মিসেস আমিন।
তুবা ছোটবেলা থেকে এমনই। চাপা স্বভাবের। পারতসাধ্বে কিছু প্রকাশ করতে চায় না কারো কাছে। সবসময়ই একটা হতাশা আর হীনমন্যতা বিরাজ করে ওর মাঝে।
মা চলে যাওয়ার পর, দরজাটা লাগিয়ে কানে হেডফোন গুজে গান শোনায় মনোযোগ দিলো তুবা।
তুবার বাবা "রুবায়েত আমিন" সাহেব একজন সরকারি অফিসার। বেশ মার্জিত ও সৎ মানুষ। ওর মাও বেশ ভালো। ধর্মকর্ম মেনে চলেন। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ওর বড় ভাই "জুনায়েদ আমিন" একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করেছে কিছুদিন আগে। চাকরি সূত্রে স্ত্রীসহ সিলেটে থাকে। খুব দ্বীনদার না হলেও বেশ রক্ষণশীল ওর পরিবারের সবাই। কিন্তু তুবাটা একদমই উচ্ছন্ন। ধর্মকর্ম তো দূরের কথা অনেকটা অ্যাগনোস্টিক টাইপের। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। ওর এই সংশয়বাদিতা শুরু হয় মূলত ওর হীনমন্যতা থেকেই।
ছোট বেলায় ওর গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বলই ছিলো। আর দেখতেও খুব কিউট ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে হতে রঙটাও কিছুটা ডার্ক হতে থাকে। এক পর্যায় সবাই যখন সুন্দর বা ফর্সা কারো সাথে ওর তুলনা করে, তখন শ্যামলা হওয়া সত্ত্বেও ওকে কালো বলে। আর সেখান থেকেই নিজের প্রতি এক ধরণের হীনমন্যতা তৈরি হয় ওর। মনের মধ্যে রাগতচিত্তে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ? তাহলে কেন আল্লাহ আমাকে কালো বানালেন? একটু ফর্সা বানালে কী এমন ক্ষতি হতো তার?
ইসলাম সম্মন্ধে জানাশোনা না থাকায়, এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্ন আর আল্লাহর ব্যাপার সংশয় জাগে তার। কিন্তু কখনো এর উত্তর জানার কোনো চেষ্টা করেনি সে। তাই জীবনের ব্যাপারে হতাশাটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে দিনকেদিন।
প্রতিটা মেয়ের মনেই ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে সুন্দর একটা কল্পনার ছক আঁকা থাকে। মনেরমতো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়াটা যেন সেই ছকের মধ্যরেখা। তাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার সাজানোর স্বপ্নটা যেন সেই কল্পছকেরই সহজাত বৈশিষ্ট্য। তুবাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এমন কল্পনা তুবার কাছে অলীক মনে হয়। ভাবলেই বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। এক ধরণের হতাশা জেঁকে বসে চারিদিক থেকে। কারণ আমদের সমাজে কালো ছেলের সুন্দরী বউ পাওয়াটা অস্বাভাবিক না হলেও, কালো মেয়ের সুন্দর বর পাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক।
তুবা এখন ভার্সিটিতে পড়ে। টিন এজ শেষ হয়েছে এবছর। কলেজলাইফে ওর বান্ধবী মারিয়া লিজাকে কতো ছেলেই যে প্রপোজাল করেছে! তুবা শুধু দেখে গেছে, আর নিজের প্রতি হীনমন্যতাই বৃদ্ধি পেয়েছে শুধু। ওকে কেউ কখনো প্রপোজ করেনি। করবেই বা কেন? ছেলেরা বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদেরকেই প্রপোজ করে। সমাজের প্যারামিটারে তুবা তো আর সেই তালিকায় নেই। এটাও তুবার হতাশা আর হীনমন্যতার পিছনের বড় একটা কারণ। আর সেখান থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অব্যক্ত একটা অভক্তি।
যেহেতু দ্বীনের বুঝ নেই, তাই বেপর্দা ঘোরাফেরা, গান শোনা, মুভি দেখা এসব নিয়েই দিন কাটতে থাকে তার। বাইরে বেরোলে মেকাপ করে নিজের শ্যামলা রঙটা আড়াল করে, স্মার্ট ড্রেসাপড হয়ে নিজেকে সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করে ঘুরে বেড়ায় সে। এভাবেই ধীরে ধীরে ফিতরাত ধর্ম থেকে থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তুবা।
পরদিন সকালে ক্লাসে যাবার সময়, রেডি হওয়ার জন্য ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসলো তুবা। গভীর মনোযোগে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে। গতকালকের ক্লাসের ঘটনাটা মনে পড়ে যায় আবারও। আনমনে ভাবতে থাকে সে,
আমার গায়ের রঙটা অন্যদের মতো ফর্সা না ঠিক। কিন্তু কুচকুচে কালোও তো নই। তাহলে সবাই কেন কালো বলে। আর কালো হওয়াটা কি আমার অপরাধ। আল্লাহই যদি সবাইকে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে আমাকেও তো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। আমার কি দোষ এখানে? আল্লাহ যদি সৃষ্টিকর্তাই হন তাহলে তিনি কেন এই বৈষম্য করলেন? আমার আম্মুর মতো আমাকে ফর্সা বানালে কী এমন ক্ষতি হতো আল্লাহর? হতাশচিত্ত এমন নানান প্রশ্ন জাগে তুবার মনে।
আচ্ছা আমি যে আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, আমি কি নাস্তিক হয়ে যাচ্ছি?
হটাৎ প্রশ্নটা মাথায় আসে তুবার। চিন্তায় ছেদ পড়ে মায়ের ডাকে,
-তুবা...
-হ্যা আম্মু, আমি রেডি হচ্ছি ক্লাসে যাবো।
আজ আর গতকালের মতো ব্রাইট মেকাপ নিলো না। হালকা মেকাপ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো তুবা।
ক্লাসে এসে দেখলো মারিয়া গতকাল যেখানে বসেছিলো আজও সেখানেই বসেছে এবং ওর ডান পাশের সিটটা খালিই আছে। তুবা গিয়ে সেখানে বসলো। সেই কোলাহলপূর্ণ ক্লাসরুম। কিন্তু তুবা একদম চুপচাপ। আজ আর কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মারিয়া বলল,
-কীরে তুবা? এখনও মন খারাপ?
-না রে। এমনিই।
মারিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে একেবারে বাঁ দিকের কর্ণারের দুটো মেয়ের দিকে চোখ পড়লো তুবার। বেশ অবাক চোখে তাকালো সেদিকে। দুজনই আপাদমস্তক কালো বোরখা পরিহিতা। শুধু বোরখাই নয়। হাতেও কালো মোজা। পায়ে কালো কেডস। দেখে তো তুবার মুখ হা হয়ে গেলো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-এরাও কি আমাদের ক্লাসের স্টুডেন্ট!
-হ্যা।
-ওরা কি মানুষ না এলিয়েন! এই গরমের মধ্যেও কেমন প্যাকেট হয়ে আছে দেখ!
-হুম। ওরা প্রতিদিন এভাবেই ক্লাসে আসে।
-গতকাল তো দেখলাম না!
-গতকাল আসেনি ওরা কেউ। আর তুই তো গতকালই প্রথম এলি। জানিস? ওরা দুজন জমজ বোন। ওরা অনেক মেধাবী।
-কিন্তু ওরা এমন প্যাকেট হয়ে ক্লাসে আসে কেন?
-ওরা অনেক ধার্মিক ফ্যামিলির মেয়ে। খুব ভালো দুজনেই, ওদের সাথে আমার কথা হয়েছিলো।
মারিয়ার কথাটা শুনে বেশ অবাক হলো তুবা।



"কালো মেয়ে"
পর্ব ৩ঃ
তুবার অবাক হওয়ার ঘোর যেন কাটছেই না। ওর ধারণাই ছিলো না ওদের বয়সী কোনো মেয়ে, এই গরমের মধ্যেও এমন পোশাকে ক্লাসে আসতে পারে! আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো সেটা যে ধর্মীয় কারণে হতে পারে সেটা ওর ধারনার বাইরে। ওর মা যদিও মোটামুটি ধর্মকর্ম মেনে চলেন। তিনি তেমন একটা বাইরে যান না। গেলেও বড় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকেঢুকে যান। ব্যাস এ এটুকুই। তবে ও ওর বড় খালাসহ রিলেটিভসদের মধ্যে বেশ কিছু বয়স্কা মহিলাদের দেখেছে বোরখা পড়তে। তাও এমন লম্বা নিকাব আর হাতমোজা সহ না। আল্লাহর প্রতি একটা অব্যক্ত রাগ থাকায় ধর্ম সম্বন্ধে কখনো তেমন কিছু জানার চেষ্টা করেনি তুবা। তাই ওদের বয়সী তরুণ কোনো মেয়ে যে ধার্মিক হতে পারে বা ধর্মীয় কারণে এমন পোশাক পড়তে পারে সেটাও ওর জ্ঞানের বাইরে। তাই ও মনে করেছে মেয়ে দুটো বোধহয় ওর থেকেও অসুন্দর এবং কালো। তাই নিজেদের অসুন্দর চেহারা ঢাকার জন্যই হয়তো এমন ড্রেস পড়েছে।
একটু পরেই সেই ম্যাম আসলেন ক্লাস নিতে। গতকালের ঘটনায় ম্যামের প্রতি চাপাক্ষোভ বিরাজ করছে তুবার মনে। কিন্তু লেকচার দেয়ার মাঝে বেশকয়েকবার ম্যাম তুবার দিকে এমন স্বাভাবিকভাবে তাকালেন যেন কিছুই হয়নি। তাই তুবাও ক্ষোভ ভুলে ম্যামের পড়া বোঝায় মন দিলো। এক পর্যায়ে ম্যাম তুবাকে পড়া বিষয়ে একটা প্রশ্ন করলো। তুবাও ঠিকঠাক উত্তর দিলো। ম্যাম বললেন,
-Good girl! Correct answer.
তারপর কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আবার বললেন, এইতো আজকে যেমন হালকা মেকআপ নিয়েছো, এমনটা নিলে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে না। তবুও, আমার মনে হয় যারা কালো তাদের এতো ফর্সা সাজার চেষ্টাটা অবান্তর।
শেষের কথাটা শুনে তুবার খুব রাগ হলো, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ম্যাম বললেন,
-Sit Down!
তারপর ক্লাসের সময় শেষ হলে, ম্যাম চলে গেলেন।
মারিয়ার দিকে ঘুরে তুবা বলল,
-আজীব এক মহিলা, অযথা কথা না শুনালে যেন উনার ভালো লাগে না।
-হ্যা, আসলেই আজতো তুই হালকাই মেকআপ নিয়েছিস এতেও উনার কী এতো প্রবলেম বুঝলাম না!
-নিজে ফর্সা তো তাই খুব অহংকার!
-ঠিক বলেছিস।
বলে মারিয়া উঠে পিছনের দিকের কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা বলতে চলে গেলো।
তুবা সপ্তাহখানেক পরথেকে ক্লাসে জয়েন করায় মারিয়া ছাড়া কাউকেই সে চেনে না। কিন্তু মারিয়া প্রথমদিন থেকেই ক্লাস করছে বিধায় বেশ কয়েকজনের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তুবা ছোটবেলা থেকেই খুব কম মানুষের সাথে মেশে। তাই যেচে কারো সাথে বন্ধুত্ব করা হয়ে ওঠে না। তবে মারিয়ার সাথে থাকতে থাকতে কিছুদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়ে যায় তুবার। কয়েকজনের সাথে ভালো বন্ধুত্বও হয়ে যায়। লিহা, নামিরা, তামান্না এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে কথাবার্তায় যাদেরকে অহংকারী এবং সৌন্দর্যের দম্ভ আছে বলে মনে হয়েছে তাদেরকে তুবা এড়িয়ে চলে সবসময়।
মারিয়ার সাথে সেই জমজ দুইবোনেও ভালোই কথা হয়। সেই সূত্রে তুবাও কথা বলেছে দুয়েকবার। একজনের নাম সাবিহা আরেকজনের নাম রাইসা। ওদের কথায় যদিও অহংকারপূর্ণ কিছু ছিলো না। থাকবেই বা কেন ওরাও তো বোধহয় তুবার মতোই অসুন্দর। কিন্তু ওদের ঐ কভারড পোশাক তুবার ভালো লাগেনি। এজন্যই হাই-হ্যালোর বাইরে তেমন কোনো আলাপ হয়নি ওদের সাথে। ক্লাস গ্যাপের সময়গুলোতে মারিরা, তামান্না, নামিরা, লিহা এদের সাথে গল্পগুজবে সময় কেটে যায় তুবার।
মাঝেমধ্যেক্লাসের বাইরে ক্যাম্পাসে বা ক্যান্টিনে গেলে লিজার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়। সবাই একসাথে আড্ডা দেয়। তবে তুবার যে চার-পাঁচ বান্ধবী আছে তাদের প্রায় সবারই বয়ফ্রেন্ড আছে বিধায় সবার একসাথে রোজ আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠে না। তবে গ্রুপ স্টাডির সময় সবকজনই একসাথে গোল হয়ে বসে পড়ে। আবার পড়ার ফাঁকেফাঁকে আড্ডাও চলে। এসব আনন্দমুখরতার মাঝেও যখন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গাছতলায় বা ক্যান্টিনে কোনো প্রেমিক কাপলের খুনসুটি আর আড্ডা চোখে পরে তখন অজান্তেই বুকের বা পাশটাতে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভূত হয় তুবার। মনের কোনে একচিলতে আফসোস উঁকি দেয়, "আমি যদি সুন্দরী হতাম আমারও হয়তো একটা সুন্দর বয়ফ্রেন্ড থাকতো। এই যে মেয়েরা প্রেম করছে এরা যদি এদের বয়ফ্রেন্ডকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নাও পায়, তবুও মনের মতো কাউকে স্বামী হিসেবে হয়তো অবশ্যই পাবে। কিন্তু আমার মতো কালো মেয়ের জীবনে না আছে বয়ফ্রেন্ড আর না হবে সুন্দর সুদর্শন কোনো স্বামী।"
এভাবেই ভার্সিটি লাইফের প্রথম দু'মাস কেটে যায় তুবার। প্রথম দিনে তুবাকে ইনসাল্ট করা সেই ম্যাম যেই স্যারের পরিবর্তে ক্লাস নিতেন ঐ স্যার ক্লাস নিতে এসেছেন আজ। বরাবরের মতোই মারিয়া আর তুবা পাশাপাশিই বসেছে।
স্যারকে দেখে বেশ ভালোই মনে হলো তুবার কাছে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, স্মার্ট বিহেভিয়ার, দেখতেও বেশ সুন্দর। ফর্সামুখে খোঁচাখোঁচা চাপ দাড়ি। অনেক সুন্দর করে পড়া বুঝাতে পারেন উনি। প্রথম দিন ক্লাসে এসেছেন উনি আজ তাই প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন। আমি "ড. জাভেদ কায়সার" তারপর ভার্সিটিতে নিজের পেশাগত অবস্থান ও পদ বললেন। এরপর স্টুডেন্টদের সবার পরিচয় জেনে নিলেন একে একে। এরপর অল্প কিছুক্ষণ পড়িয়ে ঐদিনের মতো চলে গেলেন স্যার।
এই স্যারের ক্লাস বেশ ভালোই লাগছে তুবার কাছে। পড়ানোর মাঝেমাঝে প্রায়ই স্টুডেন্টদের কাছে পড়া বিষয়ক প্রশ্ন করেন, কিন্তু না পারলেও অপ্রাসঙ্গিক কোনো মন্তব্য করেন না। সেই ম্যামের মতো তো নয়ই।
সপ্তাহখানেক ক্লাস নেয়ার মাঝেই স্টুডেন্টদের সাথে জাভেদ স্যারের বেশ ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে। একদিন স্যার পড়াচ্ছিলেন -- এক পর্যায়ে সেই জমজ দুই বোনের মধ্যথেকে সাবিহাকে পাঠ্য অধ্যায় থেকে একটা প্রশ্ন করলেন,
-এই যে... তুমি দাঁড়াও ; কী যেন নাম?
-জি স্যার, সাবিহা।
-Nice Name. হ্যা সাবিহা! তুমি কি বলতে পারবে? থার্মোস্ফিয়ারের অবস্থান কোথায়? এবং এখানকার তাপমাত্রা কেমন হয়?
সাবিহা আস্তে করে উত্তর দিলো
-জি স্যার।
-বলো তাহলে
-থার্মোস্ফিয়ারের অবস্থান হচ্ছে মেসোস্ফিয়ারের ঠিক উপরের অঞ্চলে।
স্যার বললেন,
-আরেকটু জোরে বলো শুনতে পাচ্ছি না।
সাবিহা তার উত্তরটা আবার রিপিট করল এবং বলল,
-এ অঞ্চলে সর্বোচ্চ ১২০০⁰ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা হয়।
স্যার বললেন,
-সঠিক উত্তর। প্রথমবার খুব আস্তে বলেছো তো তাই ক্লিয়ার শুনতে পাইনি।
এরপর স্যার সাবিহাকে আরো কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ও সবগুলো ঠিকঠিক উত্তর দিলো। তারপর রাইসাকেও প্রশ্ন করলেন কয়েকটা। সেও ঠিকঠাকভাবে উত্তর দিলো।
স্যার বললেন,
-আচ্ছা বোসো।
গত ক্লাসগুলোতে স্যার অনেক ছাত্রীকেই বিভিন্ন প্রশ্ন ধরেছেন। কিন্তু সাবিহা-রাইসার মধ্যথেকে কাউকে এ প্রথম দাঁড় করানোয় সবাই বেশ আগ্রহের সাথে ওদের দিকে তাকিয়েছে। কারণ এমনিতে ওরা দুজন ক্লাসের অন্যদের সাথে খুব বেশি মেশে না। তারওপর গ্রুপস্টাডি বা আড্ডায়ও ওদের পাওয়া যায় না। তাই সবাই মনে ধরেই নিয়েছে ওরা বোধহয় স্টুডেন্ট হিসেবে অতটা ভালো না। তাই সাগ্রহে সবাই শুনছিলো ওরা উত্তর দিতে পারে কি পারে না।
একটুপর স্যার আবার বললেন,
-আচ্ছা সাবিহা! যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলি...
-জি স্যার বলুন,
-ইসলামে পর্দা একটা কম্পোলসারি বিষয় তা আমি জানি। তোমরা এই তরুণ বয়সে ইসলাম মেনে চলছো, ভার্সিটিতে পড়েও বোরখা পরিধান করে ক্লাস করো এটা ভালো। কিন্তু আমি যতদূর জানি ইসলামে নিকাব পড়াটা বাধ্যতামূলক না। ইসলামে এত কঠোরতা নেই। এটা ঐচ্ছিক বিষয়। সুতরাং তোমরা বোরখা পড়ে মুখ খোলা রাখতে পারো। এতে করে গরমে কিছুটা কম কষ্ট হবে।

"কালো মেয়ে"
৪.
স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই ওদের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকালো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সাবিহা। প্রতিউত্তরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনুপল বিলম্বে ছোট আওয়াজে উত্তর দিলো,
-স্যার আমাদের এতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা এভাবেই অভ্যস্ত।
-হ্যা অভ্যস্ত হয়ে গেলে তেমন একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে মুখমণ্ডল এবং হাতের কবজি খোলা রাখা ইসলামের জায়েজ আছে। তাই আমি তোমাদেরকে সহজ অপশানটা বললাম এই আর কি।
পাশ থেকে রাইসা বলল,
-স্যার, যদি অনুমতি দেন, বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে বলি?
-হ্যা অবশ্যই!
-স্যার, অধিকাংশ স্কলারদের মতে মুখ ঢেকে রাখাও ফারজের অংশ, খোলা রাখার যে অনুমতি আছে, ওটা একান্ত প্রয়োজন হলে, যেমন ধরুন পাসপোর্ট বা রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজের ছবি তুলতে হচ্ছে তখন মুখ না খুলে তো ছবি তোলা যাবে না, এরকম ক্ষেত্রে বৈধ। সর্বাবস্থায় নয়। যদিও কিছু কিছু স্কলার বলেন, সর্বাবস্থায় বৈধ। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআনের সুরা নুর এর ৩১ নম্বর আয়াতের একটা অংশ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا অর্থাৎ "যতটুকু প্রকাশমান তা ব্যতীত মু'মিন নারীরা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে" এটাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের মতে এখানে "যতটুকু প্রকাশমান" বলতে মুখ এবং হাতের কবজি খোলা রাখাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু স্যার, আমাদেরকে এর সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে হলে দেখতে হবে এই কুরআন যেই মহামানবের ﷺ উপর নাযিল হয়েছিলো তিনি এর ব্যাখ্যাটা কীরকম বুঝেছেন এবং তার পরিবারের নারীদেরকে তিনি কীরকম পর্দা করতে বলেছেন। আর সেটা দেখলে আমরা দেখতে পাবো তারা আমাদের থেকেও অনেক বেশি কভারাপলি বোরখা, নিকাব, বড় ওড়না এবং মোজাসহই পর্দা করতেন। মুসলিম নারী হিসেবে তারাই আমাদের আদর্শ।
বলে, একটু থামলো রাইসা।
স্যার বললেন,
-বিষয়টা এরকম? জানতাম নাতো! তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো এই খোলা রাখার মতটা সার্বক্ষণিক ভাবে সঠিক নয় তাইতো?
-স্যার আমিতো স্কলার নই। তবে আমার দুটো মত সম্পর্কেই অল্পবিস্তর পড়াশুনা আছে। আমরা যদি সেসকল স্কলারের কথাও ধরি, যারা মুখ এবং হাতের কবজি খোলার রাখাকে জায়েজ বলেছেন। তারাও কিন্তু কেউ বলেননি যে এটা করা উত্তম। তারাও ঢেকে রাখাকেই উত্তম বলেছেন। ব্যাপার‍টা অনেকটা ফার্স্টক্লাস মার্ক আর টেনেটুনে পাশ মার্ক এর মতো। আমার যদি একটু কষ্ট করে হলেও ফার্স্টক্লাস মার্ক পাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে কেন আমি সেটা করবো না স্যার?
-গুড পয়েন্ট! আসলেই, তুমি ঠিকই বলেছো। বিষয়টা আসলে আমার এভাবে বিস্তারিত জানা ছিলো না। ধন্যবাদ তোমাকে।
একটুপরে ক্লাসের টাইম শেষ হয়ে যাওয়ায় স্যার চলে গেলেন।
স্যারের মতো অন্য স্টুডেন্টরাও রাইসার বলা কথাগুলো শুনছিলো। কিন্তু অন্যরা তেমন একটা গুরুত্ব দিলো কিনা ঠিক বোঝা গেলো না। স্যার চলে যাবার পর, সবাই অভ্যাসমতো গল্পগুজবে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু তুবা যেন আনমনে কিছু একটা ভাবছে। মারিয়া, লিহা ও তামান্নার সাথে গল্প করছিলো। তুবাকে চিন্তিত দেখে মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
-কী রে তুবা? কী ভাবছিস এতো?
-আচ্ছা ঐ মেয়ে দুটোর ফেস দেখেছিস কখনো? দেখতে কেমন?
-ওরাতো নিকাব খোলে না কখনো কিভাবে দেখবো? কেন বলতো?
-আমি তো এতদিন মনে করতাম ওরা বোধহয় কালো। তাই নিজেদের অসুন্দর মুখ আড়াল করার জন্যই এই বোরখা নিকাব পড়ে। কিন্তু আজ স্যারকে রাইসা মেয়েটা যেই ব্যাখ্যা শোনালো তাতে তো মনে হয় ওরা আসলেই ধর্ম মানার জন্যই এরকম পোশাক পড়ে।
-কালো না ফর্সা তা জানিনা। কিন্তু ওদের সাথে আমার কথা হয়তো প্রায়ই, ওরা আসলেই অনেক ধার্মিক।
-ওওও আচ্ছা।
ব্যাপারটা নিয়ে তুবার মনে সাময়িক ভাবনার উন্মেষ হলেও তেমন একটা স্থায়ী হলো না। স্বাভাবিক গতিতেই দিনগত হতে লাগলো তুবার। তবে অবচেতন মনেই দিনকেদিন হতাশা আর উদাসীনতার এক অজানা গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে সে। পড়ালেখায়ও মন নেই আগের মতো।
দেখতে দেখতে ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা চলে এলো। সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তুবা পড়াশোনায় বেশ পিছিয়ে আছে দেখে মারিয়া ও তামান্না ওকে কিছু সাজেশান নোট দিলো। সেগুলো নিয়েই পরীক্ষার আগের ক'দিন পড়ে মোটামুটি রকমের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলো।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরেই রেজাল্ট আসলো। রেজাল্ট নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলো তুবা। স্টুডেন্ট হিসেবে বরাবর সে কখনওই খারাপ ছিলো না। S.S.C. তে GPA-5 ছিলো। কিন্তু তার পর কলেজ ওঠার পর থেকে ধীরে ধীরে হতাশা আর হীনমন্যতা বাড়তে থাকে। সেই সাথে সমানুপাতিক হারে কমতে থাকে পড়াশোনার গতি। শেষতক H.S.C. পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষার পরে খুব করে পড়েও GPA-5 আর ধরে রাখতে পারলো না। রেজাল্ট আসলো 4.75। ভার্সিটিতে ওঠার পর এটাই প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল, কিন্তু সেভাবে ভালো প্রস্তুতি ছিলো না ওর। রেজাল্ট আসলো খুবই খারাপ। তুবা ধারণা করেছিলো ওর রেজাল্ট খুব একটা ভালো হবে না। কিন্তু CGPA যে 3 পয়েন্টেরও নিচে হবে তা বুঝতে পারেনি। মারিয়া, তামান্না, নামিরা, লিহা ওদের সবারই রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছে। ভালো হবারই কথা কেননা ওরা পড়াশুনা করেছে নিয়মিত।
কিন্তু সাবিহা আর রাইসার রেজাল্ট দেখে বেশ অবাক হলো তুবা। ক্লাসের মধ্যে সর্বোচ্চ CGPA- 3.82 পেয়েছে দুজন। তাদের একজন হলো সাবিবা! আর রাইসাও খুব বেশি পিছিয়ে নেই, 3.78 !
পরদিন ক্লাসে এসে তুবা দেখলো ক্লাসের অনেকের মুখেই ওর মতো আশ্চর্যের ছাপ। ওরা দুবোন তো ক্লাসে তেমন সাড়াশব্দও করতো, আর গ্রুপস্টাডিতে তো কখনওই দেখা যায়নি ওদের। বাসায় বসে পড়ে পড়ে এতো ভালো রেজাল্ট! ওরা আসলেই অনেক মেধাবী হয়তো। তুবার মনটা কী ভেবেই যেন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো।
কয়েকদিন পরের কথা। তুবা ক্লাসে এসে দেখলো মারিয়া ক্লাসে আসেনি আজ।
বাসায় গিয়ে মুঠোফোনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওর মা খুব অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাই আজ ক্লাসে আসেনি মারিয়া। আগামী কয়কেদিনও আসবে না।
পরদিন তুবা ক্লাসে দেরি করে যাওয়ায় সামনের দিকে সিট পেলো না। বাঁ দিকে গিয়ে রাইসার পাশের সিটে বসলো।

"কালো মেয়ে"
পর্ব ৫ঃ
ক্লাসের ফাঁকে টুকটাক কিছু কথাও হলো রাইসার সাথে। এতো ভালো রেজল্ট করা সত্ত্বেও রাইসার আচরণে কোনো দাম্ভিকতা না দেখে কিছুটা অবাক হলো তুবা। বেশ ভালোই মনে হলো রাইসাকে। এরপর থেকে প্রায়ই রাইসা ও সাবিহার সাথে অল্পস্বল্প কথাবার্তা হয় তুবার। তুবার কিছু কথাবার্তা রাইসার কাছে অদ্ভুত লেগেছে বেশ কয়েকবার। মনে হয়েছে মেয়েটার বোধহয় ধর্মের ব্যাপারে কিছুটা অরুচি আছে। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে কাউকে কিছু বলা ঠিক না বিধায় রাইসা বা সাবিহা কেউই তুবাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি।
কয়েকদিন পর মারিয়া ক্লাসে আসলো। বাঁ দিকে গিয়ে বসলো। তুবাও ওদিকেই বসেছে। পরপর কয়েকটা ক্লাস হওয়ায় আজ তেমন একটা গল্প জমে উঠলো না। তিনটা ক্লাস হওয়ার পর একটা ক্লাস গ্যাপ পাওয়ায় ক্লাস বেশ কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠলো পুরো ক্লাসরুম। একটু পরেই যোহরের আযান শোনা গেলো। আজকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হবে। লাস্ট ক্লাসটা ১. ৪৫ মিনিটে। যেদিন যেদিন এরকম দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হয়, রাইসা ও সাবিহা সেদিন ভার্সিটিতে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত কমন রুমে গিয়ে নামাজ আদায় করে। দুপুরবেলা কমন রুম প্রায় খালিই থাকে। নিরিবিলি পরিবেশে সাইডব্যাগে করে আনা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে দুবোন।
সাবিহা রাইসাকে বলল,
-রাইসা, ক্লাস শুরু হতে এখনো প্রায় চল্লিশ মিনিট বাকি। চল নামাজটা পড়ে নিই।
-হ্যা চল।
বলে উঠে দাঁড়ালো রাইসা। মারিয়া বললো,
-তোমরা কোথায় নামাজ পড়বে?
-কমন রুমে। ওখানে আরো কয়েকজন আপুও নামাজ পড়তে আসেন।
-আমিও যাবো তোমাদের সাথে।
-হ্যা, এসো তাহলে। আমাদের জায়নামাজ বেশ বড় আছে, তোমারও জায়গা হয়ে যাবে।
এরপর তিনজনে মিলে কমন রুমের দিকে গেলো।
তুবা তখন পিছনের দিকে গিয়ে লিহা ও তামান্নার সাথে গল্প করছিলো বলে খেয়াল করেনি যে মারিয়া ক্লাসের বাইরে গেছে। কিছুক্ষণ পর নিজের সিটে এসে দেখলো মারিয়া ক্লাসে নেই । নামিরাকে জিজ্ঞেস করলো,
-মারিয়া কই রে?
-ও তো বোধহয় সাবিহাদের সাথে কমনরুমে গেলো।
-এই সময়ে কমনরুমে!
-নামাজে যাচ্ছে বলল।
-ওওও আচ্ছা।
তুবার মনে পড়লো এর আগেও যেদিন যেদিন দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হয়ে সেদিন ওরা দুই বোন কমন রুমে গিয়ে নামাজ পড়ে। কিন্তু মারিয়াকে তো কখনো নামাজে যেতে দেখিনি! প্রশ্ন জাগে তুবার মনে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, কমন রুমের দিকে যায় তুবা।
গিয়ে দেখলো, মারিয়ার নামাজ পড়া শেষ। কিছুটা তাচ্ছিল্যস্বরে মারিয়াকে বলল,
-কীরে মারিয়া আজ হটাৎ নামাজ পড়তে এলি?
-আম্মু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করছি রে। আম্মুর জন্য দুয়া করছি। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে নাকি?
-না এখনও শুরু হয়নি। ট্রিটমেন্ট তো চলছে, চিন্তা করিস না আন্টি সুস্থ হয়ে যাবেন।
সাবিহা আর রাইসারও নামাজ শেষ। তুবার কথা শুনে বললো,
-তুমিও নামাজ পড়বে তুবা?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় তুবা। মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলে,
-না, আসলে তোমরা আসছিলে না তো, তাই খুঁজতে চলে এলাম।
কী ভেবেই যেন তুবা একটু থেমে রাইসাকে প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা আল্লাহ কি যে কারো দুআ কবুল করেন?
-হ্যা, দুআ কবুল হওয়ার কিছু নিয়মকানুন আছে সেগুলো মেনে দুআ করলে কবুল হবে।
কথাটা বলে, ঠিক করে বাঁধার জন্য মুখের নিকাবটা খুললো রাইসা।
রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে তুবা যেন আকাশ থেকে পড়লো! এতো সুন্দরও কি মানুষ হয়? গল্প উপন্যাসের ডানাকাটা পরীর রূপের বর্ণনা তুবা অনেক পড়েছে, গ্ল্যামার জগতের সুন্দরী মডেল অভিনেত্রীদের কৃত্রিম নিখুঁত সৌন্দর্যও অনেক দেখেছে। কিন্তু রাইসা যেন গল্প উপন্যাসের পরীর রূপের থেকে বর্ণনাতীত রূপসী! মডেল অভিনেত্রীদের কৃত্রিম সৌন্দর্য যেন রাইসার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের কাছে মিসকিন বনে যাবে! ওর চেহারার লাবণ্যময়তা যেন যে কারো দৃষ্টিকে থমকে দিতে যথেষ্ট! কী অপরূপ মুখাবয়ব! সমুদ্রের মতো সুগভীর দৃষ্টি। শরতের মেঘমুক্ত শুভ্র আকাশের মতো উজ্জ্বল মুখশ্রী। কী এক অদ্ভুত মাদকতা বিরাজমান ঐ মুখে! কিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় তুবা।
রাইসার কথায় সংবিৎ ফিরে পায়।
-কী হলো তুবা?
-হ্যা!
নিজেকে সামলে নিয়ে তুবা বলল,
-তুমি এত্তো সুন্দরী! আমি ভাবতেও পারিনি। আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তুমি রাইসা! সাবিহাও কি তোমার মতোই সুন্দরী?
-আমরাতো জমজ। দেখতে প্রায় একইরকম, আলহামদুলিল্লাহ! তবে তুমি একটু বেশিই প্রশংসা করছো।
-বেশি আর কী করলাম? তোমার সৌন্দর্যের তুলনায় নেহাত অল্পই বললাম।
মারিয়া বলল,
-তুবা! তুই আবার সৌন্দর্য নিয়ে পরলি?
-তুইও তো যথেষ্ট সুন্দরী মারিয়া। আমার মতো কালো হলে বুঝতি কালো মেয়েদের কাছে এটা কত কাঙ্ক্ষিত বস্তু। আমাদের কষ্টটা তোরা কখনওই বুঝবি না।
কথাটা বলে, মৃদু কৃত্রিম হাসি দিয়ে মুখের মলিনতা আর মনের হতাশার মেঘটা আড়াল করার বৃথাচেষ্টা করলো তুবা।
রাইসা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
-যেরকমভাবে বলছো, তুমি কিন্তু সেরকম কালো নও। আর কালো বা ফর্সায় কী আসে যায় তুবা? গায়ের রঙ বা সৌন্দর্যে দিয়ে মানুষের বিচার করাটাই বা কতটা যুক্তিসংগত?
-যুক্তিসংগত নয়। কিন্তু আমাদের সমাজের মানুষেরা তো সেটাই করে।
-সমাজের মানুষেরা কী দিয়ে বিচার করে সেটা কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেখতে হবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা কী দিয়ে মানুষকে বিচার করেন।
-কী দিয়ে মানুষকে বিচার করেন তিনি?
বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুবা।
-শোনো, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন¹ " إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ ٱللَّهِ أَتْقَىٰكُمْ" অর্থাৎ, "তোমাদের মধ্যথেকে আল্লাহর নিকট তারাই সবথেকে শ্রেষ্ঠ, যারা আল্লাহকে অধিক ভয় করে"। এর মানে হচ্ছে, কে ধনী কে গরিব, কে ছোট কে বড়, কে আরব কে অনারব, কে কালো কে ফর্সা কে শ্যামলা, কে দেখতে সুন্দর কে অসুন্দর, এসব কোনোটাই আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে কে তাকে বেশি ভয়, কে তার বিধিনিষেধগুলো কতটা ভালো ভাবে পালন করে সেটা।
বেশ অবাব ভঙ্গিতে আগ্রহভরে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। সাবিহা নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করছিলো। জায়নামাজ ব্যাগে ঢুকিয়ে রাইসাকে বললো,
-সেই হাদিছটার কথাও বলা যেতে পারে, যেখানে স্পেসিফিকভাবে চেহারা ও শরীরের কথা বলা হয়েছে!
হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে রাইসা বলল,
-ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে ওটা বলা যাবে। এখন ক্লাসে যাই চলো।
তুবা বলল,
-একটু দেরি হলে কিছু হবে না। আমি শুনতে চাই, কী বলা হয়েছে সেই হাদীছে?
মুচকি হেসে রাইসা বলল,
-শোনো তাহলে, "রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন², আল্লাহ তোমাদের শরীরের দিকে দেখেন না, তিনি তোমাদের চেহারার দিকেও দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর! অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষের শরীর বা চেহারার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে বিচার করেন না। তিনি মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য দেখে মানুষকে বিচার করেন। যাদের অন্তর হিংসা, বিদ্বেষ আর কলুষতা থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস আর তার বিধিনিষেধ মেনে চলার মানসিকতায় সজ্জিত, সে-ই আল্লাহর কাছে অগ্রগণ্য!
রাইসার কথাগুলো শুনে চিন্তার জগতে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো তুবা। আল্লাহর ব্যাপারে এতদিনের সংশয় যেন ওলটপালট হয়ে যেতে লাগলো। একটা সুধারণার মৃদু বাতাস এসে আনমনা করে দিয়ে গেলো ওকে।
চলবে...
1. সুরা হুজরাত, আয়াত : ১৩
2. সহিহ মুসলিম, হাদীস নং : ২৫৬৪



"কালো মেয়ে"
পর্ব ৬ঃ
রাইসার দিকে তাকিয়ে তুবা বলল,
-আমি এতদিন জানতাম না মানুষকে বিচার করার ব্যাপারে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গিটা এতো সুন্দর! কেউ আমাকে কখনো এভাবে বলেনি। শুধু কটাক্ষ আর কটুমন্তব্যই করে এসেছে সবাই। আর সেগুলো আমার হতাশাই বৃদ্ধি করেছে বারংবার।
-এখন তো জানলে, এখন থেকে আর হীনমন্যতায় ভুগবে না কখনো। চলো তাহলে ক্লাসে যাওয়া যাক।
-হ্যা চলো।
এরপর ক্লাসে গিয়ে বসলো সবাই। স্যার এসে পড়ানো শুরু করেছেন। সবাই স্যারের লেকচার শুনছে। কিন্তু তুবার মন নেই স্যারের কথায়। অবচেতন মনে নিজেকে প্রশ্ন করছে সে, আশেপাশের মানুষগুলোর যে দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনকে বিষিয়ে তোলে, তা পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমি সবসময় কামনা করে এসেছি, আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেছেন, তিনি মানুষকে ঠিক সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন! কতইনা ন্যায়পূর্ণ তার দৃষ্টিভঙ্গি! আর আমি কিনা এতদিন সেই সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারেই খারাপ ধারণা পোষণ করতাম? তিনিতো তার সৃষ্টির ব্যাপারে ন্যায়বান, কিন্তু আমি তার সৃষ্টি হয়েও স্রষ্টার প্রতি কি একটুও ন্যায়পূর্ণ আচরণ করতে পেরেছি? কেমন একটা অস্থিরতা শুরু হয় তুবার মনে। চিন্তাজগতে দ্রুতগতিসম্পন্ন কোনো এক সাইক্লোন যেন ঝড়োবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। যে বাতাস ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে এতদিনের ক্ষোভিত অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে, এতদিনের হতাশাব্যঞ্জক অভক্তিকে, নিজ সত্তাকে অহেতুক আড়াল করার ভুল বিশ্বাসকে! সেই সাথে মনে উঁকি দিতে লাগলো নতুন কিছু প্রশ্ন। আবেগ যেন বিবেকের কাছে শর্ত আরোপ করতে লাগলো, "যদি এগুলোর সমাধান আমাকে দিতে পারো আমি অতীতের সব অনুরাগ ছেড়ে, সব অভিযোগ ভুলে ঐ মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সপে দেবো। তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে, জীবনের শান্তি খুঁজে নেবো।"
ক্লাস শেষ হওয়ার পর তুবা রাইসাকে বলল,
-রাইসা! আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো,
-হ্যা, বলো,
-মানুষকে বিচার করার ব্যাপারে আল্লাহর মাপকাঠি সত্যিই অসাধারণ এবং নিঃসন্দেহে তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু মনে হটাৎ কিছু প্রশ্ন জাগলো, আল্লাহ কেন তার সৃষ্ট মানুষের মাঝে এতো বৈষম্য করলেন? তিনি কি সবাইকে একইরকম বানাতে পারতেন না? তাহলে তো আর ধনী-গরিব, সাদাকালো বা সুন্দর অসুন্দরের এতো ভেদাভেদ থাকতো না। কিছু মনে কোরো না রাইসা, আমি আসলে ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানিনা।
-না না মনে করার কী আছে? শোনো তুবা! আল্লাহ বলেছেন এই এই দুনিয়াটা আমাদের জন্য একটা পরীক্ষাক্ষেত্র। তিনি দেখতে চান কে আমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।³ যেহেতু তিনি ন্যায়বিচারক সেহেতু তিনি প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে ঠিক সেভাবেই বিচার করবেন যে ধরণের প্রশ্নপত্র তিনি মানুষকে দেবেন। এটাই তো ন্যায়বিচার তাই না?
-হ্যা ন্যায়বিচার তো এটাই! কিন্তু সেটার পলিসিটা কিরকম একটু বুঝিয়ে বলবে?
-ধরো কেউ একজন অনেক ধনী। এই ধনদৌলতই হচ্ছে তার জন্য পরীক্ষা! যে, সেই ব্যক্তি এতো প্রাচুর্য পেয়েও আল্লাহকে ভুলে না গিয়ে তার দাসত্ব মেনে নিলো কিনা। পৃথিবীতে আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চললো কিনা। সেই ধনদৌলত দিয়ে গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করলো কিনা। আবার ধরো, কেউ একজন অতি দরিদ্র। প্রতিদিনকার খাবার যোগাড় করতেই তার কষ্ট হয়, বিত্তবৈভব তো কল্পনাতীত। এই দারিদ্রতাই তার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা! যে, সেই ব্যক্তি এতো দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর উপর ভরসা করে, নিজের দারিদ্রতার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিতে পারলো কিনা। জীবনে আল্লাহর অবাধ্য না হয়ে, দারিদ্র্যতা দূর করতে অসৎপথে না গিয়ে সৎপথে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করলো কিনা। এখন যেহেতু তার বিত্তবৈভবের প্রাচুর্যতা নেই সেহেতু সে এই বিষয়টার জবাবদিহিতা থেকেও মুক্ত আবার যে ব্যাক্তি ধনী, সে দারিদ্যতার কারণে ইমানহারা হয়ে যাওয়ার আশংকা থেকে মুক্ত, কিন্তু তাকে দেয়া সম্পদের ব্যাপারে তাকে হিশেব দিতে হবে যে সেগুলোকে সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে ব্যয় করেছে কিনা। ঠিক অনুরূপভাবে ধরো আল্লাহ কোনো কোনো মেয়েকে অত্যাধিক সৌন্দর্য দান করেছেন এটাও যেমন তার জন্য পরীক্ষা আবার কাউকে কালো বা অসুন্দর করেছেন এটাও তার জন্য পরীক্ষা।
কথাগুলো বলে, একটু থামলো রাইসা।
খুব মনোযোগ দিয়ে সাগ্রহে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ আসতেই, আরো বিস্তারিত শোনার তৃষ্ণা অনুভব করলো সে।
-বিত্তবৈভব আর দারিদ্রের ব্যাপারটা বুঝলাম কিন্তু... সুন্দর-অসুন্দরের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। একটু ক্লিয়ার করে বলবে?
-একটা কথা নিশ্চই শুনে থাকবে, "অহংকারীদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।"
-হ্যা শুনেছি,
-তাহলে দেখো, যাকে আল্লাহ সৌন্দর্য দিয়েছেন, তার জন্য পরীক্ষাটা হচ্ছে, সে আল্লাহর এই অনুগ্রহ পেয়ে আল্লাহর প্রতি আরো বেশি কৃতজ্ঞ হলো নাকি অহংকারী হয়ে গেলো। আল্লাহর সব বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে ইসলাম মোতাবেক জীবন পরিচালনা করলো নাকি সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে বিভিন্ন পাপের দিকে পা বাড়ালো। পক্ষান্তরে যাকে আল্লাহ সৌন্দর্য দেননি বা কম দিয়েছেন তার জন্যও এটা এভাবে পরীক্ষা যে, সে এই কারণে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি নাখোশ হয়ে তার অবাধ্য হয়ে যায় নাকি আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে ধৈর্যধারণ করে। যদি সে ধৈর্যধারণ করে এবং আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে তাহলে আল্লাহর পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হবে। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য। রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,⁴ "মুমিনের ব্যাপারটা বড়ই চমৎকার! যখন তার সাথে ভালো কিছু ঘটে, তখন সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে, আর এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যখন তার সাথে (বাহ্যিক দৃষ্টিতে) খারাপ কিছু ঘটে, তখন সে ধৈর্যধারণ করে। আর এটাও তার জন্য কল্যাণকর।” আর আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,⁵ "যদি তোমরা আমার অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করো আমি তা আরো বাড়িয়ে দেবো।" আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন,⁶ "নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন"
অছেদ্য এক আবিষ্টতা নিয়ে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। মনের মধ্যথেকে সকল হতাশা আর সংশয়ের পতঙ্গ যেন একে একে মুষড়ে পরছে রাইসার ছোড়া পবিত্র তীরাঘাতে। শুরু হতে লাগলো বিবেকের নব আহ্বান! এমন সুন্দর, নির্মল, ন্যায়পূর্ণ এক জীবনব্যস্থা থেকে, এমন ন্যায়বান প্রভুর দাসত্ব থেকে আমি এতদিন কিভাবে দূরে ছিলাম? কত সুন্দর আল্লাহর ভাবনাগুলো! যিনি আমার সমাজের মানুষগুলোর মতো একচোখা নন। যিনি সৃষ্টিজগতের কোনোকিছুর মতোই নন। সেই মহান আল্লাহর থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে ছিলাম এতদিন? অপরাধবোধে চোখদুটো ভিজে উঠলো তুবার।
সাবিহা বলল,
-দেখো তুবা! আজকে তোমার গায়ের রঙ একটু অনুজ্জ্বল বলে তোমার হয়তো খুব আফসোস হয়, তোমার হয়তো মনে হয় ফর্সা হলেই ভালো হতো। কিন্তু কে বলতে পারে আল্লাহ হয়তো এর মধ্যেই তোমার জন্য কল্যাণ রেখেছেন।
-সেটা কিরকম?
কাপা কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো তুবা।
-পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারাতে আল্লাহ বলেছেন,⁷
“হয়তো তোমরা কোন একটি বিষয় পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর নয়। পক্ষান্তরে কোনো একটি বিষয় অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুত, আল্লাহই সব জানেন আর তোমরা জানো না।” তাই আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও। যদি তিনি তোমাকে কোনো কাঙ্ক্ষিত বস্তু না দিয়ে থাকেন, তবে সেটা তিনি তোমার ভালোর জন্যই করেছেন। ধরো তুমি এখন ভালো চরিত্রের মেয়ে, কিন্তু যদি তোমার অনেক সৌন্দর্য থাকতো, হতে পারতো তুমি সেই সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে অনেক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে, প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপের পথে যেতে। তাহলে, আল্লাহ তোমাকে সেই সৌন্দর্য না দিয়েই তোমার মঙ্গল করেছেন। শয়তানকে ওয়াসওয়াসা দেয়ার সুযোগ দিয়ো না তুবা। আজ যদি তুমি অসুন্দর হওয়ার ব্যাপারে হতাশ হয়ে অভিযোগ তোলো, কেন আল্লাহ আমাকে সুন্দর বানালেন না? তাহলে তো তুমি ভুলে যাবে আল্লাহ তোমাকে এমন অনেক অনুগ্রহ দিয়েছেন, যা তোমার আশেপাশের অনেককেই দেননি। আল্লাহ তোমাকে দেখার জন্য দুইটা চোখ দিয়েছেন, অথচ কোটি কোটি মানুষ চোখে দেখতে পায় না। তুমি পা দিয়ে হাঁটতে পারো অথচ কতশত মানুষ আজ পঙ্গু। কেউ হয়তো জন্মগতভাবেই এই অনুগ্রহ পায়নি, কেউবা আবার পেয়েও হারিয়েছে কোনো দুর্ঘটনাবশত। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন,⁸ “যদি তোমরা আল্লাহর নি‘আমত গণনা করো, তবে তার সংখ্যা গুনে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই যালিম এবং অকৃতজ্ঞ!"
তাই, আমরা যাতে অন্যদের সৌন্দর্য দেখে নিজেদের নিয়ে হতাশায় না ভুগি, সেজন্য আল্লাহ বলেছেন,⁹ “তুমি কখনো চোখ মেলে তাকিও না ঐসবের প্রতি যা আমি তাদের বিভিন্ন দলকে পার্থিব জীবনে উপভোগের জন্য সৌন্দর্য হিসাবে দিয়েছি। যাতে আমি সে ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমাকে দেয়া তোমার রবের অনুগ্রহই হলো সবচেয়ে উত্তম। সবচেয়ে বেশি স্থায়ী।” সুতরাং আমরা মানুষেরা যদি অকৃতজ্ঞ না হয়ে আল্লাহর সেই অনুগ্রহগুলোর কৃতজ্ঞতা আদায় করি, আল্লাহর দ্বীন ইসলাম অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে সাজাই, তাহলে তিনি আমাদেরকে পরকালের জাহান্নামের ভয়াবহ কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন, এবং চিরস্থায়ী জান্নাত দান করবেন।
একটু থেমে, সামনে বসে টলমল চোখে, তন্ময় হয়ে কথা শুনতে থাকা তুবার কাঁধে একটা হাত রেখে সাবিহা আবার বললো,
-সুতরাং, বোন আমার! এসব হতাশাকে ছুড়ে ফেলে আল্লাহ যেমন চান, তেমনি তার একজন অনুগত বান্দী হয়ে যাও। তার ইচ্ছাকে হাসিমুখে মেনে নাও। আল্লাহর ইবাদাতে মনোনিবেশ করো। সালাত-সিয়াম, ফারজ পর্দাসহ তার দেয়া সব বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করো। তাহলেই কেবল তুমি সব সমস্যার সমাধান পাবে। মানসিক প্রশান্তি হবে। হতাশা থেকে মুক্তি পাবে। সফল আর সন্তুষ্টির জীবন পাবে।
রাইসা ও সাবিহার কথাগুলো শুনে আবেগ আর অনুশোচিত চিত্তে চোখে পানি চলে এসেছিলো তুবার। সবিশেষে সাবিহার এমন আবেগঘন আহ্বানে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো তুবা। টপটপ করে গাল বেয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুরেখা। রাইসা শান্তনা দিয়া বললো,
-কেঁদো না তুবা। আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য তার দিকে ফিরে আসার রাস্তা কখনো বন্ধ করেন না।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তুবা বলল,
-আসলে আমি একটু কালো হওয়াতে বুঝতে শেখার পর থেকেই অনেক হতাশায় ভুগি। সেখান থেকেই আল্লাহ বা ধর্মের প্রতিও কিছুটা সংশয় জন্মায়। ইতঃপূর্বে আমার এসকল হতাশার ব্যাপারে ইসলামের এতো সুন্দর অভিব্যক্তি সম্পর্কে আমি জানতাম না। এতোদিনের হতাশা আর সংশয়ের সেই জমাট বাধা পাথরটা আজ তোমরা সরিয়ে দিয়েছো। এজন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
বলে, নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো তুবা।
সাবিহা নিজের হাতে তুবার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলরেখাটা মুছে দিলো। হাতমোজা ভেদ করে চোখের উষ্ণ পানির স্পর্শ অনুভব করলো নিজের আঙুলে।
তুবা বলল,
-আমি এই হতাশাময় জীবন থেকে, সন্তুষ্টির জীবনে পদার্পণ করতে চাই। সংশয় ভুলে আল্লাহর অনুগত হতে চাই। তার দেয়া বিধিনিষেধ মেনে চলতে চাই। তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে?
-অবশ্যই করবো তুবা! আমাদেরও ভালো লাগবে, আমাদের একজন পথভোলা বান্ধবী আমাদের দ্বীনের পথে চলার সাথী হবে। স্বাগতম তোমাকে এই প্রশান্তিময় জীবনব্যবস্থায়।
বলে, তুবাকে আলিঙ্গনপাশাবদ্ধ করে নিলো সাবিহা ও রাইসা।
চলবে...
নোট:
3. সূরা মুলক, আয়াত : ২
4. সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৯৯৯
5. সূরা ইব্রাহীম, আয়াত : ৭
6. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ১৫৩
7. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ২১৬
8. সূরা ইব্রাহীম, আয়াত : ৩৪
9. সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১৩১


"কালো মেয়ে"
পর্ব ৭.
এখান থেকেই শুরু হয় তুবার নতুন পথচলা। তার পরদিনই সাবিহা তুবাকে বেশ কিছু বই উপহার দেয়। একদম ওপরেই ছিলো নামাজ শিক্ষার একটা বই। বইটা দেখে তুবা বেশ খুশি হয়ে বলল,
-এই বইটাই এখন আমার অন্যসবগুলোর আগে দরকার।
-হ্যাঁ, একজন মুসলিমের জন্য সর্বপ্রথম ফারজ কাজ হলো সালাত। এখন যেহেতু তুমি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছো তাই সালাতের ব্যাপারে জ্ঞানার্জনই তোমার জন্য সবথেকে জরুরী। সেই ভাবনা থেকেই এটা দিলাম। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে আমাকে বোলো, কমন রুমে নামাজের সময় প্র‍্যাক্টিক্যালি দেখিয়ে দেবো। কেমন?
-আচ্ছা।
বলে একটা মুচকি হাসি দিলো তুবা। সে হাসির মাঝে আছে একসমুদ্র প্রশান্তি, কৃতজ্ঞতা আর আশা। হাসলে খুব মিষ্টি লাগে তুবার মুখখানি।

সেদনই ওদের কাছ থেকে, ইসলাম সম্বন্ধে-- তাওহীদ-শির্ক, ইমান-কুফরসহ সালাত, সিয়াম সম্পর্কে বেসিক কিছু বিষয় জেনে নিয়েছিল তুবা। এরপর ধীরে ধীরে চিন্তা-চেতনায়, কাজেকর্মে, আচার-আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে তুবার। প্রতিদিন ক্লাসে এসে সাবিহা ও রাইসার পাশেই বসতে শুরু করলো। ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে চলতে থাকে নতুন কিছু জানা আর সেগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। কিন্তু পর্দা করার ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ঝামেলায়ই পড়তে হলো তুবাকে। কী করবে কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তারওপর আবার গরমের প্রকোপ। কিছুটা হতাশ হয়ে রাইসা ও সাবিহার কাছে খুলে বলল ব্যাপারটা।
-আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন নামাজে নিয়মিত। কিন্তু রাইসা আমারতো পর্দাও করা উচিত, এটাও তো ফারজ। কিন্তু আমি কিভাবে তোমাদের মতো এমন আপাদমস্তক ঢেকে চলবো বুঝতে পারছি না। আমার গরমের সমস্যাটা একটু বেশিই। এমনভাবে মাথা-মুখ ঢেকে কিভাবে থাকবো-- ভাবলেই আমার আরো বেশি গরম লাগা শুরু করে। নামাজের ঐ অল্প সময়টাতে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে থাকি তাতেই আমার মাথায় প্রচুর অস্বস্তি লাগে। গরম লাগা শুরু করে। তোমরা দুবোন কত সুন্দর ওড়না-নিকাব পরো।
সাবিহা বলল,
-শোনো তুবা! আমাদের এখানে অনেক গরম ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ এর থেকেও অনেক গুণ বেশি! আর আমরা যারা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী, তারা সেই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য দুনিয়ার এই কষ্টকে সামান্যই আমলে নেবো। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা বলেছেন,¹⁰ "আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার চাপিয়ে দেন না।"
কথাটা আসলেই সত্য। বাহ্যিক ভাবে যদিও আমাদের মনে হয় এই গরম আমাদের জন্য অসহ্য। কিন্তু আমাদেরকে আল্লাহ "অভিযোজন ক্ষমতা" নামক একটা অনুগ্রহ দান করেছেন। যার বলে আমরা যেকোনো অবস্থার সাথে সময়ের পরিক্রমায় নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারি। এজন্যই দেখবে আমাদের এখানকার তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানকার মানুষ ওখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে মানিয়ে নিতে পারছে, আবার ডিসেম্বরে ২০⁰ -২৫⁰ সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেই আমাদের এখানে অনেক শীত থাকে, অথচ ঐ সময় ইউরোপ-আমেরিকাতে মাইনাস তাপমাত্রা থাকে, তবুও এখানকার অনেক মানুষ ঐসময় ঐসব দেশে গিয়ে দিব্যি নিজেদেরকে মানিয়ে নেয়। সুতরাং একটু চেষ্টা করলে তুমিও মানিয়ে নিতে পারবে। এতো আপসেট হওয়ার কিছু নেই, শুধু বিশ্বাস রাখো যেহেতু আল্লাহ তোমাকে হিদায়াতের আলো দিয়েছেন, সেহেতু এই পথের বাঁধা গুলোকেও তিনি সহজ করে দেবেন। আর তাছাড়া আমাদের বুঝতে হবে যে দুনিয়া হচ্ছে পরীক্ষার জায়গা। পরীক্ষা তো একটু কঠিন মনে হবেই। আর নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণের নামই তো ইসলাম।
সাবিহার কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো তুবার কাছে।
রাইসা বলল,
-আর শোনো তুবা, শয়তানের ধোঁকায় পোড়ো না। তুমি এখন দ্বীন প্র‍্যাক্টিস করতে শুরু করেছো তো, শয়তান চাইবে তোমাকে গরমের ভয় দেখিয়ে, "লোকে কী বলবে" এই চিন্তাসহ নানান ভাবনাচিন্তা মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে দ্বীন থেকে দূরে রাখতে। এসবে পাত্তা দিয়ো না। একসাথে পুরোপুরি পর্দা শুরু করবো ভেবে বসে থাকলে মাঝখানের দিনগুলোতে শয়তানকেই সন্তুষ্ট করা হবে। তার চেয়ে বরং আস্তে আস্তে ধাপেধাপে পুরোপুরি পর্দা করার চেষ্টা করতে থাকো। তাহলে, আল্লাহর পথে চেষ্টাটা অন্তত করা হবে।
-কীভাবে করবো? একটু বুঝিয়ে বলো
-প্রথমে যেটা করবে সেটা হচ্ছে, ক্লাসে, বাসায়, বাইরে সবজায়গায়ই লম্বা এবং ঢিলেঢালা জামা পরবে যাতে শরীরের গঠনরূপ বোঝা না যায়, আর মাথায় ওড়না রাখবে সবসময়। কষ্ট হবে, অস্বস্তি লাগবে, গরম লাগবে, মাথা ব্যাথা করবে-- তারপরও মাথা ঢেকে রাখবে, এগুলোই পরবে। আর সালাতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ কর‍তে থাকবে যাতে তিনি তোমার দ্বীন পালনের সমস্ত বাধাবিপত্তি গুলো দূর করে দেন। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় কিছুদিন পরেই তুমি যখন মাথা ঢেকে রাখায় এবং এই পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখনই বোরখা ও নিকাবে আর কোনো সমস্যা হবে না ইন শা আল্লাহ!
রাইসার পরামর্শ বেশ মনে ধরলো তুবার। আসলেই তো আমি এতদিন সবকিছু একসাথে শুরু করবো ভেবে বসে ছিলাম অথচ একটু একটু করে শুরু করলে এতোদিনে অনেকটাই এগিয়ে থাকতাম।

এরপর রাইসা ও সাবিহার পরামর্শ অনুযায়ী নিজেকে পূর্ণ দ্বীনদার একজন মুসলিমাহ হিসেবে প্রস্তুত করতে অধ্যবসায় চালিয়ে যেতে থাকে তুবা। রোজ সে ক্লাসে আসে ফুল স্লিভের জামা পরে, মাথায় ওড়না দিয়ে। সেভাবেই ক্লাস করে। ক্যাম্পাসের এথাসেথা ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস আগে থাকলেও এখন আর নেই। ক্লাস, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি আর যেদিন দুপুর পর্যন্ত ক্লাস থাকে সেদিন রাইসা ও সাবিহার সাথে কমন রুমে গিয়ে সালাত আদায় করা পর্যন্তই তুবার ঘোরাফেরা। মারিয়াও সালাতে যায় ওদের সাথে। তুবা এখন মারিয়াকেও পূর্ণ দ্বীন মেনে চলার পরামর্শ দেয়। রাইসা-সাবিহার দেয়া বইগুলো পড়ে ইসলাম সম্মন্ধে টুকটাক জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। এরপর কুরআন পড়াও শিখতে শুরু করে। দুনিয়ার চোখে অসুন্দরের হীনমন্যতায়, হতাশায় নিমজ্জিত কালো মেয়েটা আল্লাহর দ্বীনের সৌন্দর্যে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে থাকে দিনকেদিন।
দেখতে দেখতে আরো একটা সেমিস্টার কেটে যায়। তুবার রেজাল্টে যদিও আগের থেকে খুব বেশি উন্নতি হয়নি, কিন্তু তুবা এখন আর মানসিকভাবে হতাশায় ভোগে না আগের মতো। তাই মন দিয়ে আরেকটু বেশি পড়লেই সামনে রেজাল্ট ভালো হবে ইন শা আল্লাহ।
রাইসা ও সাবিহার সাথে সম্পর্কটা আগের থেকে গাঢ় হয়েছে। ওদের প্রতি তুবা চিরকৃতজ্ঞ। ওদের উছিলায়ই মেয়েটা প্রশান্তিময় সেই বাতাস খুঁজে পেয়েছে, যার অভাবে হতাশার দাবদাহে অন্তরটা তৃষ্ণার্ত হয়েছিলো এতগুলো বছর।

থার্ড সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। তুবা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলো। এমন সময় সাবিহা ও রাইসাও আসলো লাইব্রেরিতে। তুবার পাশেই গিয়ে বসলো দুজন।
একটু পর ওরা যেখানে বসেছে তার পিছনে এবং ডান পাশের তাকে বই খোঁজার বাহানায় একটা ছেলে একাধিকবার এসে আবার অন্যদিকে চলে গেলো। যাওয়ার সময়ে আড়চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছিলো। বিষয়টা কারোই দৃষ্টি এড়ালো না। তুবা অবশ্য বই পড়ায়ই মনোযোগী ছিলো। সাবিহা রাইসার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলল,
-এই সেই ছেলেটা না?
-হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে!
-তুবার কাছে জিজ্ঞেস কর, কে এটা?
-এখন না, ছেলেটা লাইব্রেরি থেকে বের হোক, তখন জিজ্ঞেস করছি...
ছেলেটা বাইরে যাওয়ার পর তুবাই রাইসাকে বলল,
-রাইসা, একটা বিষয় গত কয়েকদিন ধরে বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কিভাবে বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে ভুল বুঝোনা কিন্তু হ্যাঁ?
-ধুর বোঁকা মেয়ে! ভুল কেন বুঝবো? একজন মু'মিন কখনো মিথ্যা বলে না। কী হয়েছে খুলে বলো
-ঐ ছেলেটাকে দেখলে না? যে এখানে বই খুঁজতে এসেছিলো।
-হ্যাঁ!
-ওর সাথে লাইব্রেরিতেই পরিচয়। নাম রিফাত। দেখতে শুনতে ভালোই। ভদ্রও বেশ। প্রায়ই লাইব্রেরিতে আমার টেবিলের অপোজিটে এসে বই পড়তে বসতো। ক্যান্টিনেও দেখা হয়েছে কয়েকবার। সেই সুবাদে টুকটাক দুএকটা কথাও হয়েছে। কথা শুনে মনে হলো, ছেলেটা বেশ ধার্মিকও। ধর্মীয় জ্ঞান আছে অনেক। সেজন্যই মূলত একটুআধটু কথা বলেছিলাম আর কি। কিন্তু সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে লাইব্রেরিতে বসেই বললো, আমাকে নাকি সে পছন্দ করে। প্রথমে ভেবেছিলাম মজা করছে, আমার মতো কালো মেয়েকে ওর মতো সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে কেন পছন্দ করতে যাবে? কিন্তু পরে সিরিয়াসলিই প্রোপোজ করলো।
-তুমি যেমনটা বলছো তুমি ততটাও কালো নও। আর তোমার মুখটা খুব মিষ্টি তো। আচ্ছা যাক, তারপর তুমি কী বললে?
-আমি বললাম, দেখুন! আমি ছেলে মেয়েদের এসব প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। আমার পক্ষে আপনার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করা সম্ভব না।
-মাশাআল্লাহ, তুবা! সোজাসাপ্টা কিন্তু একেবারে সঠিক উত্তরই দিয়েছো।
-হ্যাঁ, আমি তোমাদের উছিলায় দ্বীন সম্বন্ধে এখন অল্পস্বল্প হলেও তো জানি তাই না? বিয়ে বহির্ভূত এসব প্রেম ভালোবাসা ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু ছেলেটা আমাকে বলল,
-ঠিক আছে। প্রেম করতে হবে না। পড়াশুনা শেষ হলে না হয়, আমরা পারিবারিকভাবে বিয়ে করবো। আর ততদিন বন্ধুর মতো থাকবো একে অপরের সাথে।
-তারপর তুমি কী বললে?
-কিছু বলিনি। সে বলেছে ভেবেচিন্তে পরে যেন জানাই। কিন্তু তারপর আর কথা হয়নি। আজ জানতে এসেছিলো হয়তো, কিন্তু তোমাদেরকে দেখে আর কিছু বলেনি। এই বিষয়টাই তোমাদেরকে জানাতে চাচ্ছিলাম। বিষয়টা মনের ভেতর খটকা লাগছিলো খুব। এরকম বন্ধুত্ব ঠিক হবে?
রাইসা কিছু বলার আগেই সাবিহা বললো,
-মাথা খারাপ তোমার? যেই কারণে বিয়েবহির্ভূত প্রেম নিষিদ্ধ সেই একই কারণে ছেলে-মেয়েদের এমন বন্ধুত্বও নিষিদ্ধ।
সাবিহার এমন দ্রুত উত্তরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তুবা বলল,
-একটু বুঝিয়ে বলো, আমিতো আসলে জানিনা।
এরপর রাইসা বলল,
-শোনো তুবা! তুমি কি মাহরাম এবং নন-মাহরাম সম্বন্ধে জানো?
-হ্যাঁ! রক্তের সম্পর্কের ১৪ জন পুরুষ ব্যাতীত সবাই নন মাহরাম। সাবিহার দেয়া একটা বইতে পড়েছিলাম। কুরআনেও পেয়েছি পরে।
-আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে বিষয়টা বোঝা তোমার জন্য সহজ হবে। শোনো, নন মাহরামদেরকে দেখা দেয়া এবং তাদের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলাও ইসলামে নিষিদ্ধ। তাদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে সেইফ করা ফারজ। কারণ এখান থেকেই ফিতনার সূচনা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,¹¹ "ফিতনা হচ্ছে অন্যায় হত্যার থেকেও কঠিন অপরাধ।" এজন্যই ইমানের হেফাজতের জন্য যেমন নিজের দৃষ্টি সংযত রাখা আবশ্যিক তেমনি যেসব কাজে ফিতনার আশংকা থাকে সেসব থেকে দূরে থাকাও আবশ্যিক। আর এ কারণেই ইসলাম নন-মাহরামদের সাথে দেখা করা ও অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতাকে নিষিদ্ধ করেছে। এধরণের আলাপ থেকেই ধাপেধাপে প্রেমের খোলসে সীমালঙ্ঘন হয়। আর তাছাড়া আমরা তো যিনা ব্যাভিচারকে সবাই ঘৃণা করি, তাই না তুবা?
-হ্যাঁ অবশ্যই! এটাতো নিকৃষ্ট পাপের কাজ!
-হ্যাঁ। তবে তুমি হয়তো জানো না, শুধু অবৈধ দৈহিক মিলনকেই যিনা বলে না। ওটা যিনার চূড়ান্ত পর্যায়। আরো বিভিন্ন ধরণের যিনা রয়েছে। রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,¹² "চোখের যিনা হলো নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করা, কানের যিনা হলো শ্রবণ করা, মুখের যিনা হলো কথোপকথন, হাতের যিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হেঁটে যাওয়া, অন্তরের যিনা হলো আকাঙ্ক্ষা এবং কামনা করা।" তাহলে তুমিই বলো, একজন নন মাহরামের সাথে শারীয়াহ যেই সীমারেখা টেনে দিয়েছে তা লঙ্ঘন করে যখন অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা বলা হবে তখন কি সেটা যিনার অন্তর্ভূক্ত হবে না?
-হ্যাঁ, তাইতো হবে। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমিতো বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখিনি। আর এই হাদীছটাও জানতাম না!
সাবিহা বলল,
-এজন্যই ইমানের দাবী হচ্ছে যেখানে যিনার আশংকা আছে সেখান থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,¹³ "যিনার ধারেকাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই ওটা অশ্লীলতা ও বিপথগামীতা।"
এরপর রাইসা বললো,
-তাহলে, প্রিয় বান্ধবী আমার! এখন কী আর বুঝিয়ে বলতে হবে, কেন শুধু বিয়ে বহির্ভূত প্রেম নয়, এসব বন্ধুত্বও ইসলামে নিষিদ্ধ?
মুচকি হেসে তুবা উত্তর দিলো,
-নাগো, আমার রূপসী বান্ধবীদ্বয়! আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।

চলবে...

নোট:
10. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ২৮৬ এবং সূরা মু'মিনুন আয়াত : ৬২
11. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত: ১৯১
12. সহিহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৬৯২৫, সুনান আল বাইহাকি: হাদীছ নং- ১৩৮৯৩
13. সূরা আল ইসরা, আয়াত: ৩২


"কালো মেয়ে"
পর্ব ৮;
এমন সময় মারিয়া আসলো লাইব্রেরিতে।
-শাহজাদীরা সবাই তাহলে এখানে বসে গল্প করা হচ্ছে? আর আমি কমন রুম, ক্যান্টিন কোথায় আপনাদেরকে খুঁজে পাচ্ছি না!
মারিয়ার কথা শুনে হেসে দিলো সবাই। সাবিহা জিজ্ঞেস করল,
-কেন? স্যার এসেছে ক্লাসে?
-না। আজকে আর ক্লাস হবে না। চলে গেছে সবাই। তোমরা যাবে না?
-ওওও তাই? হ্যাঁ যাবো তো। রাইসা চল তাহলে। তুবা তুমিও চলো, একা একা বসে থেকে কী করবে?
-হ্যা চলো...

বাসায় আসতে আসতে রাইসা ও সাবিহার আজকের বলা কথাগুলো স্মরণ করছিলো তুবা। সত্যিই ওদের উছিলায় আল্লাহ আমাকে আবারও সঠিক পথ দেখালেন। আল্লাহ ওদের ভালো করুন, কত সুন্দর ভাবে ওরা আমাকে ইসলামের বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলে। আল্লাহ ওদের জ্ঞানকে আরো বৃদ্ধি করে দিন।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালো তুবা। লাইব্রেরি থেকে বেরোনোর সময় কানেকানে বলা সাবিহার কথাটা মনে পড়লো তুবার...
-তুবা, সৌন্দর্য নামক অনুগ্রহটা কেবল গায়ের রঙেই নয়, গড়নেও থাকে। আল্লাহ তোমাকে সেই অনুগ্রহটা দিয়েছেন। আর উভয় সৌন্দর্য হেফাজতে রাখার জন্যই আল্লাহ পর্দার বিধান দিয়েছেন। তাই নিকাব আর বোরখা পরা শুরু করে দাও আল্লাহর নাম নিয়ে। আল্লাহর বিধান মেনে, তার দেয়া অনুগ্রহগুলো হেফাজত করলে, এই বন্ধুত্ব বা প্রেম নামক খুতওয়াতুশশাইত্বন¹⁴ থেকে আল্লাহই তোমাকে হেফাজত করবেন, ইনশাআল্লাহ!

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের মুখে আনমনেই এক চিলতে লজ্জামাখা হাসির রেখা দেখতে পায় তুবা। সত্যিই বলেছে সাবিহা। আমার বোরখা-নিকাব পরেই চলা উচিত। তাছাড়া ওড়না আর ফুল স্লিভের জামায় এখন তো আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন আর কীসের অজুহাত?
যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরদিন ক্লাস শেষে রাইসা ও সাবিহার সাথে মার্কেটে গিয়ে বোরখা ও নিকাব কিনে আনলো তুবা। এরপর থেকে প্রতিদিন এই ড্রেসেই ভার্সিটিতে যায় সে। বাসার সবাই তুবার এই পরিবর্তনে বেশ খুশিই হলো। তুবার মা খুশি হলো বেশি। হবেই বা না কেন? আগে তো মেয়েকে শত বলে কয়েও নামাজ পড়াতে পারতো না। আর এখন মেয়ে নিজে থেকেই নামাজ পড়ে। বোরখা পরে। তাও নিকাব সহ। তুবার দেখাদেখি ওর মাও বাইরে যেতে হলে বোরখা-নিকাব পরে বাইরে যায় এখন। অবশ্য এর পিছনে তুবার ভূমিকা আছে। মা'কে বুঝিয়েছে সে, পর্দা করা কতটা জরুরী। তুবার বাবাও ওর পরিবর্তনে বেশ খুশি।

এভাবেই দিন কাটতে থাকে তুবার। কিছুদিন পর তুবা সাবিহা-রাইসার মতো হাতেপায়ে মোজাও পরা শুরু করলো। হটাৎ দেখলে তিনজনকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যায় ক্লাসের সহপাঠীদের কাছেও। একইরকম কালো বোরখা, কালো রঙের বড় আরাবিয়ান নিকাব, হাতে কালো মোজা, পায়ে কালো কেডস। চোখের দিকে না তাকালে কারো বোঝার সাধ্যি নেই কোনটা সাবিহা বা রাইসা আর কোনটা তুবা।

যেই মেয়েটা একসময় গান, মুভি আর ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। সেই মেয়েটা ভার্সিটিতে উঠে দুটো পরশপাথরের ছোঁয়ায় ইসলামের রঙে রঙিন হয়ে সুন্নাতী জীবনযাপন শুরু করলো। তিনজনে মিলে মাঝেমধ্যে অন্য ক্লাসমেটদেরকে টুকটাক দ্বীনের দাওয়াত দেয়াও চালিয়ে যেতে থাকে। হিদায়াত দেয়ার মালিক তো আল্লাহ। আমরা মানুষেরা আমাদের অবস্থান থেকে অন্তত সাধ্যানুযায়ী চেষ্টাটুকু তো করতে পারি। ওরাও সেটাই চালিয়ে যেতে লাগলো।

দিনেদিনে আল্লাহর ইবাদাতে আরো নিবেদিতা হতে থাকে তুবা। ফারজ সালাতের পাশাপাশি তাহাজ্জুদগুজারওহয়ে ওঠে মেয়েটা। নিয়মিত ক্লাসের পড়া, সেইসাথে ততোধিক গুরুত্ব দিয়ে কোরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা করে সে। অপ্রয়োজনে এখন আর বাইরে বেরোয় না মেয়েটা। এভাবেই নীরবে নিভৃতে হতাশায় ভরা জীবন থেকে বেরিয়ে এসে, আশাচিত্ত দৃঢ় ইমানের একজন মুসলিমাহ হওয়ার প্রয়াস অব্যাহত থাকে তুবার।

দেখতে দেখতে লাস্ট সেমিস্টারের এক্সাম সামনে চলে আসে। থার্ড সেমিস্টারের পর থেকেই রেজাল্টও আগের থেকে ভালো হতে শুরু করে। কিছুদিন পরই ফাইনাল এক্সাম। আরেকটু ভালো করে পড়াশুনা করলেই টোটাল বেশ ভালো একটা CGPA আশা করা যায়। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হতে না হতেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো তুবা। "চিকনগুনিয়া" নামক ভাইরাসজনিত এক জ্বর চারিদিকে মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে শোনা যাচ্ছে। আগের সেই তুবা হলে হয়তো অসুস্থতার জন্য রাগে ক্ষোভে আল্লাহকে যা তা দোষারোপ করতো। কিন্ত এখনকার তুবা তো দ্বীন বোঝে। সে জানে, সুস্থতার মতো অসুস্থতাও আল্লাহর একটি নিআমাত। অসুস্থতার মাধ্যমে আল্লাহ কিছু গুনাহ মাফ করে দেবেন ইন শা আল্লাহ। এটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। ধৈর্যের পরীক্ষা। তাই অধৈর্য হওয়া যাবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যধারণ করতে হবে। কেননা কুরআন বলছে,¹⁵ "যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।" তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে, অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষায় বসলো তুবা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর রহমতে সুস্থও হয়ে গেলো। দু'তিনটা পরীক্ষা অবশ্য একটু খারাপ হয়েছে। তবুও সে একদমই অসন্তুষ্ট নয়। কারণ এটাই হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো। আর মু'মিনদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সর্বদা আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা।

কিছুদিন পর রেজাল্ট আসলো। রেজাল্ট পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো তুবা। CGPA খুব বেশি ভালো না হলেও ফার্স্টক্লাস পয়েন্ট এসেছে আলহামদুলিল্লাহ।

সময়মতো মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গেলো তুবা। আগের বান্ধবীরা একেকজন একেদিকে চলে গেছে। অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে, কেউবা জব করছে। কারো সাথেই তেমন একটা যোগাযোগ নেই তুবার। তবে মারিয়া আর সাবিহা-রাইসার সাথে যোগাযোগ আছে। সাবিহা আর রাইসাকে কি ভোলা যায়? ওদের উছিলায়ই তো হতাশার অতলে হারিয়ে যেতে থাকা মেয়েটা আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। ব্যাকুল হৃদয়ে খুঁজেফেরা প্রশান্তিময় জীবন পেয়েছে। সকল হতাশা আর হীনমন্যতা ভুলে আন্তরিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে।
ওদের দুজনারও বিয়ে হয়ে গেছে। আল্লাহর দয়ায় ওরা ওদের মতোই দ্বীনদার জীবনসঙ্গী পেয়েছে। তুবার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চেষ্টা করছে সেই ফাইনাল পরীক্ষার পর থেকেই। কিন্তু এখনও তেমন আশানুরূপ কিছু হয়নি। গত কয়েকমাসে প্রায় ৮/৯টা সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু একটাও বেশিদূর এগোয়নি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা পরিবার সিভি দেখে কথা এগিয়েছিলো কিন্তু মেয়ে দেখতে এসে তারা তুবাকে পছন্দ করেনি। একেবারে ফর্সা না হলেও তাদের চাহিদা আরেকটু উজ্জ্বল গায়ের রঙ। কিন্তু তুবার তো তা নয়। তুবার বাবা মাও বেশ হতাশ হয়ে পড়েছে তুবাকে নিয়ে। তুবা যদিও প্রথম দিকে মানসিক ভাবে বেশ শক্ত ছিলো, কিন্তু এতগুলো প্রস্তাব এসে কয়েকটা ওকে দেখতে এসে, ডিনাই করে দেয়ায় তুবাও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাবাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে বলল,
-বাবা, তোমরা এতো টেনশান কেন নিচ্ছো বলোতো?
-টেনশান নেবো না? বাবা হলে বুঝতি রে মা। এতোগুলো সম্বন্ধ আসলো কিন্তু একটাতেও কিছু করতে পারলাম না। আর তোর নিজেরও তো কোনো পছন্দ নেই যে, নিশ্চিন্তে সেখানে সম্বন্ধ পাকা করবো।
-এটা তো সম্ভব না বাবা। কলেজ লাইফে হয়তো সুযোগ ছিলো। কিন্তু ভার্সিটিতে উঠে তো আল্লাহ দ্বীনের বুঝ দিলেন। এসব হারাম সম্পর্কে তো কোনওমতেই জড়ানো সম্ভব না।
-হ্যা, তাতো ঠিকই। আল্লাহ তোকে আজীবন এমনভাবে দ্বীন মেনে চলার তাওফিক দিক মা।
বলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন রুবায়েত সাহেব।
-আমীন। তোমরা এতো হতাশ হয়ো না বাবা। আল্লাহ যা তাকদীরে রেখেছেন, তাই হবে। আল্লাহ যদি কারো জন্য আমাকে নির্ধারণ করে থাকেন, তবে আজ হোক আর কাল হোক তার সাথেই বিয়ে হবে বাবা। খামাখা দুশ্চিন্তা করে তোমরা অসুস্থ হয়ে পোড়ো না।

আল্লাহর উপর মেয়ের তাওয়াক্কুল দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন তুবার বাবা। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। আরো কয়েকটা প্রস্তাব আসলো, কিন্তু কালো বলে অনেক দ্বীনদার ছেলেরাও বিয়েতে রাজি হয় না। সবাই চায় দ্বীনদারির পাশাপাশি একটু সুন্দরী মেয়ে। খুব বেশি ফর্সা না হোক অন্তুত একটু উজ্জ্বল শ্যামলা।

চলবে...

নোট:
14. খুতওয়াতুশশাইত্বন হচ্ছে, শয়তানের দেখানো পথ বা এমন কাজ, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ নয়, কিন্তু বাস্তবে তা শয়তানের পাতানো ফাঁদ।
15. সূরা তালাক, আয়াত: ০৩

কালো মেয়ে"
--
শেষ পর্ব
.
তুবা বুঝে উঠতে পারে না, এরা দ্বীনদার হওয়া সত্ত্বেও কেন দ্বীনদারির থেকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের এতো গুরুত্ব দেয়। যখন দ্বীনের বুঝ ছিলো না, তখন বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিলো তুবার। স্বপ্ন দেখতো ফর্সা, সুন্দর, হ্যান্ডসাম একজন জীবনসঙ্গীর। এখনও যে মন চায় না, তা না। তবে আগের মতো সেই অন্ধ আকর্ষণটা এখন আর নেই। তাছাড়া ভারসাম্য না থাকলে দুজনার দাম্পত্য জীবনে সমস্যাও হতে পারে। সব মিলিয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে দ্বীনদারির মর্যাদা এখন তুবার কাছে অনেক বেশি। এখন তার কাছে একজন দ্বীনদার স্বামীর জীবনসঙ্গিনী হয়ে, তার হাতে হাত রেখে জান্নাতের দিকে ছুটে চলাটাই একমাত্র স্বপ্ন। এটাই এখন তুবার দৃষ্টিতে সফল জীবন। সে হোক কালো বা ফর্সা তাতে কী আসে যায়?
কিন্তু পড়াশুনা প্রায় শেষ। চাকরিবাকরি করারও ইচ্ছা নেই তুবার। বাবা মা চেষ্টা করেও বিয়ের কোনো ব্যবস্থা করতে পারছেন না। একটু একটু দুশ্চিন্তা হতে থাকে তুবার। দিনকেদিন দুচিন্তায় প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটা।
তবে আশাহত হয় না। আল্লাহ তো আছেন। তার হাতেই তো ভাগ্যের চাবিকাঠি। তার কাছেই মনের সব অব্যক্ত দুশ্চিন্তা আর আকুতিগুলো ব্যক্ত করে তুবা। আরো বেশি তাহাজ্জুদ, কুরআন পাঠ, দিনের নফল সালাতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করে তুবা। আবেগময় প্রার্থনা চলতেই থাকে। নিজের অসহায়ত্বকে নিবেদিত মনে সর্বাশয়ে তুলে ধরে মহান রবের দরবারে। ইয়া আল্লাহ! তুমিইতো সেই মহান সত্তা, যে তার এই অসহায় দাসীর একমাত্র সহায়। তুমিইতো সেই অন্তর্যামী প্রভু, যে তার এই অনুগতার হৃদয়ের আকুতি চোখেরজলের মাঝেই পড়ে নিতে পারে। একটা সময় দ্বীন বুঝতাম না। তুমিই হিদায়াত দিয়েছো। তোমার সাহায্য না থাকলে আজ ইসলাম মেনে চলাও হতো না আমার। সময়ের প্রয়োজনে আমার বাবা মা চাচ্ছেন তাদের মেয়েকে উত্তম পাত্রস্থ করতে। আমিও চাই দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে তোমার দেয়া হিদায়াতের পথে সেই মানুষটার হাত ধরে জান্নাত পানে ছুটে চলতে। কিন্তু পরিস্থিতি তো সবই তোমার জানা, হে আমার মালিক! যদি আমার জন্য তেমন কাউকে তুমি নির্ধারণ করে থাকো, তবে তা হবে আমার ও আমার পরিবারের জন্য আনন্দের। আর তুমি যদি আমার জন্য একাকী জীবন কাটানো উত্তম মনে করো, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকবো। জানবো আমি একা নই। আমার রব সর্বদা আছেন আমার সাথে। কিন্তু আমার বাবা মা এটা ভেবে কষ্ট পাবেন যে তাদের মেয়ে কালো বলে আজ তারা তাকে বিয়ে দিতে পারলো না। মানুষতো বোঝেনা, কালো ফর্সা এগুলো সৌন্দর্যের মাপকাঠি নয়, উভয়ই তোমার ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি উত্তম ফায়সালাকারী হে আল্লাহ!
কখনো কখনো জীবনঘনিষ্ঠ কিছু ব্যাপার যেমন মানুষকে জীবনের ব্যাপারে আরো বেশি তৎপর করে তোলে, তেমনি অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদাতও তুবার ইমানী সৌন্দর্যকে আরো লাবণ্যময় করে তুলতে থাকে।
কিছুদিন পর তুবার ভাইয়ার ট্রান্সফার হওয়াও সিলেট থেকে সস্ত্রীক বাড়িতে চলে আসে। তুবার ভাবিও বেশ খুশি হলো যে অনেকদিন পর আবার পরিবারের সাথে থাকা হবে। তুবাকে সে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। স্বামীর পরিবারইতো তার পরিবার।
তুবার ভাবি এসে শশুড়কে জানায়,
-বাবা, আমার এক বান্ধবীর সাথে সেদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো, ওর ছোটো ভাইয়ের জন্য ওরা একটা দ্বীনদার মেয়ে খুঁজছে। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। অনেক দ্বীনদার ছেলে। যদি আপনি অনুমতি দেন, তো তুবার ব্যাপারে ওদের সাথে কথা বলতে চাই।
-হ্যাঁ কথা বলতে পারো। তবে তুবার ডিটেইলস একটা সিভি পাঠিয়ে দিয়ো তাদেরকে। যাতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে আমাদের মেয়ে কিন্তু দেখতে তেমন ফর্সা না। তবে অনেক দ্বীনদার আলহামদুলিল্লাহ।
-হ্যাঁ, বাবা। শেষবার যখন আপনার ছেলের ছুটিতে বেড়াতে এসেছিলাম, তখনও দেখেছি। আর এখন তো আলহামদুলিল্লাহ তখনকার থেকেও এখন অনেক বেশি দ্বীনদার আমাদের তুবা। ওর দ্বীনের প্রতি জজবা সত্যিই হৃদয়গলানোর মতো। আমি নিজেও ওকে দেখে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি আমার বান্ধবীকে সব জানিয়েছি বাবা। ও বলেছে ওদের সুন্দরী চাই না। একটা ভালো দ্বীনদার মেয়ে চাই। সে কালো হলেও অসুবিধা নেই। আর আমাদের তুবাতো খুব বেশি কালো না।
-আচ্ছা, তাহলে তাদের সাথে কথা বলে তাদেরকে একদিন মেয়ে দেখতে আসতে বলো।
-আচ্ছা বাবা।
তুবার ভাবি রুমে গিয়ে বান্ধবীকে ফোন করে জানালো, তারা যেকোনো দিন মেয়ে দেখতে আসতে পারে। বান্ধবী বলল, বাসায় কথা বলে জানাবে যে কবে আসতে পারবে।
তারপর, দিন ঠিক করে একদিন তারা তুবাকে দেখতে এলো। ছেলের সাথে তার বড়ো আপু আর বাবা মা এসেছে। ছেলের নাম জারিফ মাহমুদ। সুন্দর মুখশ্রী। মুখের দাড়ি যেন যেই সৌন্দর্যকে পুরুষালি জৌলুস এনে দিয়েছে। জারিফের বাবাও তেমনই মার্জিত মানুষ। অধিকাংশ দাড়িই পাকা, কিন্তু সব এখনও শাদা হয়নি। উভয়ের পোশাকআশাকে তাকওয়ার ছাপ স্পষ্ট। জারিফের আপু আর মা দুজনেই পূর্ণ হিজাবে আচ্ছাদিতা। দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেলো তুবার পরিবারের সবার। নাস্তার পর্ব শেষ হলে, তুবার বাবা তাঁদেরকে মেয়ে দেখার অনুরোধ করলেন। জারিফের বাবা বললেন, মেয়ে দেখাতো শারঈভাবে ছেলে আর তার মা-বোনের জন্য অনুমিত। আমি বরং এখানেই অপেক্ষা করি ওরা দেখে আসুক।
জারিফ আর তার আপু ও আম্মুকে ভেতরের রুমে, তুবাকে দেখতে নিয়ে যাওয়া হলো। তুবার ভাইয়া ছিলেন তুবার সাথে। জারিফের আম্মুকে ওর আপু আগেই জানিয়েছে সবকিছু যে, মেয়ে শ্যামবর্ণা। উজ্জ্বলও নয় রঙ। তবে অনেক দ্বীনদার আলহামদুলিল্লাহ। তিনিও তাতেই বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি যা ভেবেছিলেন, এখন তুবাকে দেখে ভাবনার থেকে বেশ ভালোই লাগলো তার কাছে। এমনিতে তুবার মুখটা খুব মিষ্টি দেখতে। তুবার কাছে গিয়ে বসতেই তুবা উনাকে সালাম দিলেন। উত্তর দিয়ে উনি বললেন,
-তোমার নাম কী মা?
-তুবা।
-তুমি কি নিকাব-হাতমোজা সহ বোরখা পরো?
-জি।
-তা মা, তুমি কি মাহরাম - নন মাহরাম মেইন্টেইন করে চলো?
-জি আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন,
-মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে, জিনাত। এখন তুই আর জারিফ কথা বলে দেখ।
-আচ্ছা আম্মা। তুমি বরং তাহলে তোমার হবু বিয়েন সাহেবার সাথে গিয়ে কথা বলে এসো।
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তুবার ভাইয়া বললেন, আম্মু ঐপাশের রুমে আছে। বলে, তিনি রুম দেখিয়ে দিলেন।
একবার সলজ্জ চোখে জারিফ তাকালো তুবার দিকে। তারপর আপুর কানেকানে বলল,
-আমি সামনের রুমে যাচ্ছি আপু!
-কী? পছন্দ হয়েছে?
-আমার রিকুয়ারমেন্ট তো তুমি জানোই আপু। যাস্ট সুন্নাহ পালনের নিয়াতেই দেখতে আসা। কথা বলে, বোঝার চেষ্টা করো সে দ্বীনের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। তোমার পারফেক্ট মনে হলেই আমি চোখবুজে বিয়ে করে নেবো ইন-শা-আল্লাহ!
তুবা বুঝতে পারছে না, এরা মেয়ে দেখতে এসে কী এতো কানাঘুষা করছে। জারিফ তুবার ভাইয়াকে বলল,
-ভাইয়া, যদি কিছু মনে না করেন, চলুন আমরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। আপু আর উনি একটু কথা বলুক।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, অসুবিধা নেই চলুন।
এতোক্ষণ মাথা নীচু করে বসে ছিলো তুবা। জারিফ আর ওর ভাইয়া কথা বলার সময় প্রথমবারের মতো জারিফের দিকে তাকালো তুবা। আল্লাহু আকবার! এতো সুন্দর মানুষটা আমাকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে! এও নিশ্চয়ই অপছন্দ করে চলে যাবে। কিন্তু তাহলে আপুকে আবার কী কথা বলতে রেখে গেলো? জারিফের আপু উঠে গিয়ে তুবার পাশে বসলো। হাসিমুখে বলল,
-এই যে ভাবী সাহেবা! আমার সামনে লজ্জা পেতে হবে না। মুখটা তুলুন মুহতারামা।
মুখটা তুলে, মুচকি একটা হাসি দিয়ে তুবা বললো,
-আমি নই আপু! আপনি হলেন আমার কাছে মুহতারামা!
-সে পরে দেখা যাবে কে মুহতারামা। এখন বলো আমার ভাইকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে? ও মা-শা-আল্লাহ অনেক দ্বীনদার। নিজের ভাই বলে বলছি না, আমার জীবনে দেখা সবথেকে তাকওয়াবান পুরুষ আমার ভাই।
-উনাকে যে কারোই পছন্দ হবে আপু। উনিতো অনেক সুন্দর মা-শা-আল্লাহ! কিন্তু আমাকে হয়তো উনার পছন্দ হয়নি।
-না রে বোকা মেয়ে। ও অনেক লাজুক তো তাই উঠে চলে গেছে। আমাকে কথা বলতে বলেছে। তোমার ভাবীর কাছে তোমার ব্যাপারে যা শুনেছি তারপর খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি আর এখন দেখে যা মনে হচ্ছে, তাতে সবমিলিয়ে আমার কাছে তোমাকে পারফেক্ট মনে হয়েছে। আর আমার ভাইয়েরও এতেই মত আছে। সুতরাং এখন তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে বিয়েটা আজই পাকাপাকি করে যাবো আমরা।
কথাটা শুনে মনে এক পশলা ভালোলাগার বৃষ্টি বয়ে গেলেও, মুহূর্তেই দুশ্চিন্তার মেঘ মৃদু গর্জে উঠলো তুবার মনে।
-আমার কোনো আপত্তি নেই আপু। কিন্তু বাহ্যিক দিক থেকে কি আমি উনার যোগ্য?
-ফর্সা রঙে কি আর যোগ্যতা লেখা থাকে? শোনো তুবা! আমার ভাইটা প্রতিজ্ঞা করেছিলো, দ্বীনদারিতার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে, জীবনে একটা মেয়েকেই দেখবে, আর তাকেই বিয়ে করবে। ওর ইমানের লেভেলটা তোমাকে আর তাফসির করে বুঝাতে চাচ্ছি না বোন আমার! আমরাও তাই আসার আগে তোমার ব্যাপারে যথাসাধ্য খোঁজখবর নিয়েই এসেছি। তোমার পরহেজগারিতা আমাদের মনে ধরেছে। তোমার সুন্দর মনটা তোমার বাহ্যিকতাকে ছাপিয়ে গেছে। আমার ভাই চামড়ার সৌন্দর্য চায় না। এরকম একটা সুন্দর মন চায়। আর গায়ের রঙে কী আসে যায়। সাদা-কালো উভয়ইতো আল্লাহর সৃষ্টি। তাই আল্লাহ চাহে তো তুমিই ওর জন্য পারফেক্ট। আর তোমার মতো মেয়ের জন্য আমার ভাইও পারফেক্ট হবে ইন-শা-আল্লাহ। সুন্দরী খোঁজা চোখগুলো তোমার মতো মুত্তাকী হৃদয়ের মেয়ের জন্য বড়োই বেমানান।
আপুর কথাগুলো শুনে, দুশ্চিন্তার মেঘগুলো গর্জনধ্বনি থামিয়ে, প্রশান্তির বৃষ্টি বইয়ে দিলো তুবার মনে।
-তাহলে তুবা!
-জি আপু,
-তুমি মত দিচ্ছো তো?
-জি ইন-শা-আল্লাহ! এ আমার পরম সৌভাগ্য আপু!
-আলহামদুলিল্লাহ!
বলে, তুবাকে বাহুপাশাবদ্ধ করে আলিঙ্গন করলেন জিনাত আপু। এমন সময় তুবার ভাবী আসলো ওদের রুমে। দুই বন্ধবী অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুজনেই বেশ প্রীতি প্রকাশ করলেন। তারপর দুই পরিবারর বিয়ের দিনতারিখ ঠিকঠাক করার পর জারিফরা চলে গেলো।
কয়েকদিন পর। এক জুমাবারে মাসজিদে সুন্নাতী পরিবেশে বিয়ে হয়ে গেলো জারিফ ও তুবার। বিয়ের দিন আনন্দ, খুশি আর কৃতজ্ঞতার এক মিশেল অনুভূতিতে চোখের কোণেঘেঁষে জল চলে এলো তুবার। সবকিছু যেনো একটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো তার কাছে। জিনাত আপুর কথাটা মনে পড়তেই কেমন এক বিস্ময়াবিষ্টতা অনুভব হলো তুবার। জারিফ প্রতিজ্ঞা করেছিলো " একটা মেয়েকেই দেখবে আর তাকেই বিয়ে করবে"। ব্যাস আপু এতোটুকুই বলেছিলো। যার মানে হচ্ছে, কোনো মেয়েকেই সে দেখে না। আল্লাহর আদেশ মেনে নিজের দৃষ্টিকে সে সর্বদা হেফাজত করে চলে। সুবহানআল্লাহ! তুবাতো আল্লাহর কাছে শুধু একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী চেয়েছিলো। আর আল্লাহ তাকে, দ্বীনদারিতার পাশাপাশি এতো সুন্দর একজন জীবনসঙ্গী দিলেন, যার তাকওয়া আর ইমান তার সৌন্দর্যের থেকেও বেশি! সুবহানআল্লাহ! নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম ফায়সালাকারী। এজীবনে এমন একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী পেলে একটা মেয়ের আর কিইবা চাই?
তাওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং নিবেদিত মনে আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে অভ্যস্ত করায়, তুবার কালো হওয়া কিংবা অতীতের অজ্ঞতাপূর্ণ জীবন, এমন সুন্দর আকাঙ্ক্ষিত পবিত্র জীবনের পথে বাধা হতে পারেনি। এমন স্বপ্নপুরুষ, এমন ইমানদার একজন জীবনসঙ্গী, ক'টা সুন্দরী মেয়ের ভাগ্যে জোটে? কালো মেয়েকে তো অনেক ছেলেই বিয়ে করে তবে হয় সেটা, মেয়ের বাবার সম্পত্তি দেখে, নয়তো মেয়ের ভালো চাকরি দেখে। ক'জন আছে যারা শুধু মেয়ের চিত্ত লাবণ্যময়তা দেখে বিয়ে করে?


*★ সমাপ্ত ★*
কাল্পনিক শিক্ষামূলক গল্প: "কালো মেয়ে"