Wap4dollar.com

Sunday 18 November 2018

কালো মেয়ে শিক্ষামূলক গল্প


১.
ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে গত সপ্তাহ থেকে। কিন্তু অসুস্থ থাকায় ক্লাসে যেতে পারেনি তুবা। সে হিসেবে আজকেই ভার্সিটিতে ওর প্রথম দিন। বেশ ব্রাইট মেকাপ করে আজ ভার্সিটিতে এসেছে তুবা। চেহারার অনুজ্জ্বলতা ঢাকতে বরাবরই খুব সতর্ক সে। ভার্সিটিতে এসেই তুবার চোখ লিজা আর মারিয়াকে খুঁজে ফিরছে। ওরা দুজনেই তুবার কলেজফ্রেন্ড।
মারিয়াকে ফোন করল তুবা,
-হ্যা রে, কই তুই?
-এইতো ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকলাম কেবল।
-আমি ক্লাসে আছি, চলে আয়।
-আমাদের ক্লাস কোন বিল্ডিং-এ?
-গেট থেকে সোজা এসে ডান দিকের বিল্ডিং এর দোতলায়। চলে আয় তাড়াতাড়ি।
-হ্যা আসছি।
বলে ফোন কেটে ক্লাসের দিকে গেলো তুবা।
ক্লাসে গিয়ে মারিয়ার পাশের সিটে বসলো। পুরো ভার্সিটিতে সব স্টুডেন্টসই তার অচেনা। শুধু মারিয়া আর লিজাই পরিচিত। মারিয়া আর তুবা একই ডিপার্টমেন্টে কিন্তু লিজাটা অন্য ডিপার্টমেন্টে।
বসে সামনেপিছনে দেখতে লাগলো তুবা। সবাই একে অপরের সাথে গল্পগুজবে ব্যস্ত। বেশ কোলাহলপূর্ণ রুমটা।
মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
-কী রে? কী দেখছিস?
-দেখছি, আমাদের ক্লাসে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে!
- এতে আশ্চার্য হওয়ার কিছুই নেই। আমাদের ডিপার্টমেন্টে কোনো ছেলে নেই বুঝলি?সুতরাং মেয়েই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
-আরে, ঐ ডান দিকের মেয়েটাকে দেখ, কী ফর্সা আর কী সুন্দর! ওর পিছনের মেয়েটাও অনেক ফর্সা। তোর মতো সুন্দর।
-তোর কি মাথায় সারাদিন খালি সৌন্দর্যতত্ত্বই ঘোরে?
-আমি নিজে কালো তো তাই সৌন্দর্যের প্রতি আমার একটু বেশিই দুর্বলতা। হিহিহি...
হেসে উত্তর দিলো তুবা।
-দেখ তুবা, তুই কালো না। শ্যামলা। আর তোর ফেস কাটিং অনেক ফর্সা মেয়ের থেকেও সুন্দর। আর আজকে তুই কত সুন্দর করে সেজে এসেছিস। দারুণ লাগছে তোকে!
-হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবে না।
-মিথ্যে কেন বলবো? তুই তো এমনিতে সুন্দরই। শুধু গায়ের রঙটা একটু চাপা।
-ওই হলো। তোর মতো ফর্সা তো আর নই। আর মেকাপ ছাড়া তো সবাই কালোই বলে...
বলেই মুখটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেলো তুবার...
মারিয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো এরই মধ্যে একজন ম্যাম ঢুকলেন ক্লাসে। গল্পগুজব বন্ধ হয়ে সবার কনসার্ন সেদিকে গেলো।
ম্যাম এর দিকে তাকিয়ে তুবার চোখ তো ছানাবড়া! এত্ত সুন্দরও কি মানুষ হয়! নীল রঙের শাড়িতে ম্যামকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কী ফর্সা গায়ের রঙ! হাতগুলো দেখলে মনে হয় যেন মোমের তৈরি!
একটু কালো বা শ্যামবর্ণের মেয়েগুলো বোধহয় এমনই হয়। মুখে যতো যাই বলুক না কেন, ভেতরে ভেতরে ঠিকই সুন্দরী বা ফর্সা কাউকে দেখলে মনের মধ্যে একটু আক্ষেপ জন্ম নেয়। নিজের প্রতি বিদ্বেষ বাসা বাঁধে। আমি কেন ওরকম নই। তুবাও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অন্যদের থেকে একটু বেশিই আক্ষেপ তার মনে। এমনিতে সে শ্যামবর্ণা, তবে খুব স্মার্ট এবং মেধাবীও। কিন্তু আমাদের ঘুণেধরা সমাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদেরকে বিচার করে সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। আবার সেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ণীত হয় চামড়ার উজ্জলতার ভিত্ততে। সেই হিসেবে তুবার মনে নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ জন্মানোটাই স্বাভাবিক।
ম্যাম স্ট্রিক দিয়ে প্রজেক্টরে দেখাচ্ছেন আর লেকচার দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তিনি তুবাকে লক্ষ্য করে বললেন,
-ইউ গার্ল! স্ট্যান্ড আপ।
তুবা দাঁড়িয়ে বলল,
-ইয়েস ম্যাম
-তুমি কি আজ নতুন?
-জি ম্যাম।
-এ কয়দিন আসোনি কেন?
-আমি অসুস্থ ছিলাম ম্যাম।
-ওহ আচ্ছা। বসতে পারো।
বলে, আবার বোর্ডের কাছে গেলেন ম্যাম। কী ভেবেই আবার ঘুরে বললেন,
-শোনো!
বসতে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়িয়ে তুবা বলল,
-জি ম্যাম
তুবার আপাদমস্তক একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে ম্যাম বললেন,
-শোনো মেয়ে, এটা ক্লাস রুম। বিউটি কাম্পিটিশান স্টেইজ না। এতো মেকাপ নিয়েছো কেন?
ম্যামের কথায় বেশ থতমত খেয়ে যায় তুবা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটা। ম্যাম আবার বললেন,
-তারুণ্যের বয়স তোমাদের, মেকাপ একটুআধটু করতেই পারো কিন্তু, কালো মেয়েরা এতো মেকাপ করলে দেখতে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে। ড্রেসাপ তো বেশ স্মার্ট। এটুকুও বোঝো না? সুন্দর সাজতে গিয়ে ভুতের মতো লাগলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী লাগে, বুঝেছো?
ম্যামের কথা শুনে ক্লাসের সব মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো। ম্যামের তিরস্কার শুনে লজ্জায় অপমানে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তুবা। সবার বিদ্রুপাত্মক হাসি শুনেও সেদিকে তাকানোর সাহস হলো না মেয়েটার। অপমানবোধে কান্না চলে আসছিলো। নেহাত ক্লাস বলেই কোনওমতে কান্না চেপে, মৃদু কণ্ঠে বলল,
-জি ম্যাম।
-ঠিক আছে, বসতে পারো



"কালো মেয়ে"
পর্ব ২ঃ
চেহারায় কিছুটা বিরক্তিভাব প্রকাশ করে, ম্যাম আবার পড়ানোয় মনোনিবেশ করলেন। ক্লাসের বাকিটা সময় মাথা নিচু করে বসে থাকলো তুবা। ক্লাসের সময় শেষ হলে, ম্যাম চলে গেলেন। এরপর সবাই আবার যে যার মতো গল্পগুজবে মেতে উঠলো। তুবার বেঞ্চের আশেপাশের কয়েকটা মেয়ে তুবার দিকে তাকাচ্ছে আর ম্যামের করা মন্তব্য নিয়ে কানাঘুষো আর হাসাহাসি করছে একে অপরের সাথে। ব্যাপারটা যেন কাটা ঘায়ে নুনেরছিটের মতো বিঁধছে ওর মনে।
তুবা মাথানিচু করে চুপচাপ বসে আছে দেখে মারিয়া বলল,
-মন খারাপ করিস না তুবা। এই ম্যামটা এমনই। উনি অন্য আরেক স্যারের পরিবর্তে এযাবৎ চারটা ক্লাস নিলেন, প্রত্যেক ক্লাসেই কাউকে না কাউকে অযথা কথা শুনিয়েছেন।
-তুই ই বল মারিয়া, আমি কি ভুতের মতো মেকাপ নিয়েছি? এতগুলো মেয়ের সামনে আমাকে কীসব যা তা বলে অপমান করলো!
-না। বাদ দে তো মন খারাপ করিস না।
-আসলে সমস্যা আমার মেকাপে না। সমস্যা হচ্ছে আমার গায়ের রঙে। আমি কালো তো। কালো হয়ে জন্মানোটাই বোধহয় জগতের সবথেকে বড় পাপ!
মারিয়া কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সত্যিইতো শ্যামলা বা কালো মানুষগুলোর প্রতি, ফর্সা মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিটাই এমন বিদঘুটে যে, তারা যেন মানুষই না। উজ্জল গায়ের রঙেই যেন সব শ্রেষ্ঠত্ব।
-আমার ভালো লাগছে না মারিয়া। আজ আর ক্লাস করবো না বাসায় চলে যাচ্ছি;
-চলে যাবি? আজতো বেশি ক্লাস হবে না। আর তো একটা ক্লাস আছে। শেষ করে যা।
-নাহ। ভালো লাগছে না।
বলে উঠে চলে গেল তুবা।
ম্যামের কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। অবশ্য কারো গায়ের রঙ কালো হলে এরকম কষ্ট আর তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। তুবা যদিও একেবারে কালো নয়। শ্যমবর্ণের। কিন্তু রঙটা চাপা। তাই কালোই বলে অনেকে।
তুবারা দুই ভাইবোন। তুবার মা যদিও বেশ ফর্সা কিন্তু ওর বাবা কালো। ছেলে মেয়ে দুজনে বাবা মায়ের মাঝামাঝি রঙ পেয়েছে। তবে ছেলেরা শ্যামলা বা তার থেকেও একটু ডার্ক, যাই হোক না কেন, এমনকি কালো হলেও সমাজের খুব বেশি যায় আসে না। ভালো সার্টিফিকেট আর ভালো চাকরিবাকরি থাকলেই, কালো ছেলেও হয়ে যায় রাজপুত্র। বিয়ের ক্ষেতেও তেমন সমস্যা হয় না তাদের। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি একটু অনুজ্জ্বল শ্যামলা হয় তাহলেই যেন সে অসুন্দরের প্রতীক। আর কালো হলে তো কথাই নেই। যতোই যোগ্য, গুণবতী বা দ্বীনদারই হোক না কেন, সমাজের চোখে তারা দ্বিতীয় শ্রেনির মানুষ। বিয়ের ক্ষেত্রেও যেন তারা একেবারে অচ্ছুত! এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু জেনারেল পরিবারগুলোতেই নয়, দ্বীনি পরিবারগুলোতেও বিয়ের জন্য প্রথম রিকোয়ারমেন্ট হয় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা! অবশ্য এই সুন্দরীর মাপকাঠি যে "সাদাচামড়া" সে আর বলাই বাহুল্য। আমাদের সমাজের এই বর্ণবাদী ধ্যানধারণা যে কত সুস্থ মানুষের জীবনকেও বিষয়ে তুলছে তা যদি এই সমাজ বুঝতো!
বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো তুবা। ফ্রেশ হয়ে এসে, বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। কিছুটা হালকা লাগছে এখন। ম্যামের বলা কথাগুলো আর ক্লাসের মেয়েদের বিদ্রুপাত্মক হাসির কথা মনে পড়তেই মনটা আবারও বিষাদে ছেয়ে যায় তুবার। মা এসে জিজ্ঞেস করল,
-কী রে মা মন খারাপ নাকি?
-না আম্মু, কিছু না।
-আচ্ছা তাহলে রেস্ট নে।
বলে চলে গেলেন, মিসেস আমিন।
তুবা ছোটবেলা থেকে এমনই। চাপা স্বভাবের। পারতসাধ্বে কিছু প্রকাশ করতে চায় না কারো কাছে। সবসময়ই একটা হতাশা আর হীনমন্যতা বিরাজ করে ওর মাঝে।
মা চলে যাওয়ার পর, দরজাটা লাগিয়ে কানে হেডফোন গুজে গান শোনায় মনোযোগ দিলো তুবা।
তুবার বাবা "রুবায়েত আমিন" সাহেব একজন সরকারি অফিসার। বেশ মার্জিত ও সৎ মানুষ। ওর মাও বেশ ভালো। ধর্মকর্ম মেনে চলেন। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ওর বড় ভাই "জুনায়েদ আমিন" একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করেছে কিছুদিন আগে। চাকরি সূত্রে স্ত্রীসহ সিলেটে থাকে। খুব দ্বীনদার না হলেও বেশ রক্ষণশীল ওর পরিবারের সবাই। কিন্তু তুবাটা একদমই উচ্ছন্ন। ধর্মকর্ম তো দূরের কথা অনেকটা অ্যাগনোস্টিক টাইপের। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। ওর এই সংশয়বাদিতা শুরু হয় মূলত ওর হীনমন্যতা থেকেই।
ছোট বেলায় ওর গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বলই ছিলো। আর দেখতেও খুব কিউট ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে হতে রঙটাও কিছুটা ডার্ক হতে থাকে। এক পর্যায় সবাই যখন সুন্দর বা ফর্সা কারো সাথে ওর তুলনা করে, তখন শ্যামলা হওয়া সত্ত্বেও ওকে কালো বলে। আর সেখান থেকেই নিজের প্রতি এক ধরণের হীনমন্যতা তৈরি হয় ওর। মনের মধ্যে রাগতচিত্তে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ? তাহলে কেন আল্লাহ আমাকে কালো বানালেন? একটু ফর্সা বানালে কী এমন ক্ষতি হতো তার?
ইসলাম সম্মন্ধে জানাশোনা না থাকায়, এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্ন আর আল্লাহর ব্যাপার সংশয় জাগে তার। কিন্তু কখনো এর উত্তর জানার কোনো চেষ্টা করেনি সে। তাই জীবনের ব্যাপারে হতাশাটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে দিনকেদিন।
প্রতিটা মেয়ের মনেই ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে সুন্দর একটা কল্পনার ছক আঁকা থাকে। মনেরমতো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়াটা যেন সেই ছকের মধ্যরেখা। তাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার সাজানোর স্বপ্নটা যেন সেই কল্পছকেরই সহজাত বৈশিষ্ট্য। তুবাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এমন কল্পনা তুবার কাছে অলীক মনে হয়। ভাবলেই বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। এক ধরণের হতাশা জেঁকে বসে চারিদিক থেকে। কারণ আমদের সমাজে কালো ছেলের সুন্দরী বউ পাওয়াটা অস্বাভাবিক না হলেও, কালো মেয়ের সুন্দর বর পাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক।
তুবা এখন ভার্সিটিতে পড়ে। টিন এজ শেষ হয়েছে এবছর। কলেজলাইফে ওর বান্ধবী মারিয়া লিজাকে কতো ছেলেই যে প্রপোজাল করেছে! তুবা শুধু দেখে গেছে, আর নিজের প্রতি হীনমন্যতাই বৃদ্ধি পেয়েছে শুধু। ওকে কেউ কখনো প্রপোজ করেনি। করবেই বা কেন? ছেলেরা বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদেরকেই প্রপোজ করে। সমাজের প্যারামিটারে তুবা তো আর সেই তালিকায় নেই। এটাও তুবার হতাশা আর হীনমন্যতার পিছনের বড় একটা কারণ। আর সেখান থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অব্যক্ত একটা অভক্তি।
যেহেতু দ্বীনের বুঝ নেই, তাই বেপর্দা ঘোরাফেরা, গান শোনা, মুভি দেখা এসব নিয়েই দিন কাটতে থাকে তার। বাইরে বেরোলে মেকাপ করে নিজের শ্যামলা রঙটা আড়াল করে, স্মার্ট ড্রেসাপড হয়ে নিজেকে সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করে ঘুরে বেড়ায় সে। এভাবেই ধীরে ধীরে ফিতরাত ধর্ম থেকে থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তুবা।
পরদিন সকালে ক্লাসে যাবার সময়, রেডি হওয়ার জন্য ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসলো তুবা। গভীর মনোযোগে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে। গতকালকের ক্লাসের ঘটনাটা মনে পড়ে যায় আবারও। আনমনে ভাবতে থাকে সে,
আমার গায়ের রঙটা অন্যদের মতো ফর্সা না ঠিক। কিন্তু কুচকুচে কালোও তো নই। তাহলে সবাই কেন কালো বলে। আর কালো হওয়াটা কি আমার অপরাধ। আল্লাহই যদি সবাইকে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে আমাকেও তো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। আমার কি দোষ এখানে? আল্লাহ যদি সৃষ্টিকর্তাই হন তাহলে তিনি কেন এই বৈষম্য করলেন? আমার আম্মুর মতো আমাকে ফর্সা বানালে কী এমন ক্ষতি হতো আল্লাহর? হতাশচিত্ত এমন নানান প্রশ্ন জাগে তুবার মনে।
আচ্ছা আমি যে আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, আমি কি নাস্তিক হয়ে যাচ্ছি?
হটাৎ প্রশ্নটা মাথায় আসে তুবার। চিন্তায় ছেদ পড়ে মায়ের ডাকে,
-তুবা...
-হ্যা আম্মু, আমি রেডি হচ্ছি ক্লাসে যাবো।
আজ আর গতকালের মতো ব্রাইট মেকাপ নিলো না। হালকা মেকাপ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো তুবা।
ক্লাসে এসে দেখলো মারিয়া গতকাল যেখানে বসেছিলো আজও সেখানেই বসেছে এবং ওর ডান পাশের সিটটা খালিই আছে। তুবা গিয়ে সেখানে বসলো। সেই কোলাহলপূর্ণ ক্লাসরুম। কিন্তু তুবা একদম চুপচাপ। আজ আর কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মারিয়া বলল,
-কীরে তুবা? এখনও মন খারাপ?
-না রে। এমনিই।
মারিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে একেবারে বাঁ দিকের কর্ণারের দুটো মেয়ের দিকে চোখ পড়লো তুবার। বেশ অবাক চোখে তাকালো সেদিকে। দুজনই আপাদমস্তক কালো বোরখা পরিহিতা। শুধু বোরখাই নয়। হাতেও কালো মোজা। পায়ে কালো কেডস। দেখে তো তুবার মুখ হা হয়ে গেলো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-এরাও কি আমাদের ক্লাসের স্টুডেন্ট!
-হ্যা।
-ওরা কি মানুষ না এলিয়েন! এই গরমের মধ্যেও কেমন প্যাকেট হয়ে আছে দেখ!
-হুম। ওরা প্রতিদিন এভাবেই ক্লাসে আসে।
-গতকাল তো দেখলাম না!
-গতকাল আসেনি ওরা কেউ। আর তুই তো গতকালই প্রথম এলি। জানিস? ওরা দুজন জমজ বোন। ওরা অনেক মেধাবী।
-কিন্তু ওরা এমন প্যাকেট হয়ে ক্লাসে আসে কেন?
-ওরা অনেক ধার্মিক ফ্যামিলির মেয়ে। খুব ভালো দুজনেই, ওদের সাথে আমার কথা হয়েছিলো।
মারিয়ার কথাটা শুনে বেশ অবাক হলো তুবা।



"কালো মেয়ে"
পর্ব ৩ঃ
তুবার অবাক হওয়ার ঘোর যেন কাটছেই না। ওর ধারণাই ছিলো না ওদের বয়সী কোনো মেয়ে, এই গরমের মধ্যেও এমন পোশাকে ক্লাসে আসতে পারে! আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো সেটা যে ধর্মীয় কারণে হতে পারে সেটা ওর ধারনার বাইরে। ওর মা যদিও মোটামুটি ধর্মকর্ম মেনে চলেন। তিনি তেমন একটা বাইরে যান না। গেলেও বড় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকেঢুকে যান। ব্যাস এ এটুকুই। তবে ও ওর বড় খালাসহ রিলেটিভসদের মধ্যে বেশ কিছু বয়স্কা মহিলাদের দেখেছে বোরখা পড়তে। তাও এমন লম্বা নিকাব আর হাতমোজা সহ না। আল্লাহর প্রতি একটা অব্যক্ত রাগ থাকায় ধর্ম সম্বন্ধে কখনো তেমন কিছু জানার চেষ্টা করেনি তুবা। তাই ওদের বয়সী তরুণ কোনো মেয়ে যে ধার্মিক হতে পারে বা ধর্মীয় কারণে এমন পোশাক পড়তে পারে সেটাও ওর জ্ঞানের বাইরে। তাই ও মনে করেছে মেয়ে দুটো বোধহয় ওর থেকেও অসুন্দর এবং কালো। তাই নিজেদের অসুন্দর চেহারা ঢাকার জন্যই হয়তো এমন ড্রেস পড়েছে।
একটু পরেই সেই ম্যাম আসলেন ক্লাস নিতে। গতকালের ঘটনায় ম্যামের প্রতি চাপাক্ষোভ বিরাজ করছে তুবার মনে। কিন্তু লেকচার দেয়ার মাঝে বেশকয়েকবার ম্যাম তুবার দিকে এমন স্বাভাবিকভাবে তাকালেন যেন কিছুই হয়নি। তাই তুবাও ক্ষোভ ভুলে ম্যামের পড়া বোঝায় মন দিলো। এক পর্যায়ে ম্যাম তুবাকে পড়া বিষয়ে একটা প্রশ্ন করলো। তুবাও ঠিকঠাক উত্তর দিলো। ম্যাম বললেন,
-Good girl! Correct answer.
তারপর কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আবার বললেন, এইতো আজকে যেমন হালকা মেকআপ নিয়েছো, এমনটা নিলে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে না। তবুও, আমার মনে হয় যারা কালো তাদের এতো ফর্সা সাজার চেষ্টাটা অবান্তর।
শেষের কথাটা শুনে তুবার খুব রাগ হলো, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ম্যাম বললেন,
-Sit Down!
তারপর ক্লাসের সময় শেষ হলে, ম্যাম চলে গেলেন।
মারিয়ার দিকে ঘুরে তুবা বলল,
-আজীব এক মহিলা, অযথা কথা না শুনালে যেন উনার ভালো লাগে না।
-হ্যা, আসলেই আজতো তুই হালকাই মেকআপ নিয়েছিস এতেও উনার কী এতো প্রবলেম বুঝলাম না!
-নিজে ফর্সা তো তাই খুব অহংকার!
-ঠিক বলেছিস।
বলে মারিয়া উঠে পিছনের দিকের কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা বলতে চলে গেলো।
তুবা সপ্তাহখানেক পরথেকে ক্লাসে জয়েন করায় মারিয়া ছাড়া কাউকেই সে চেনে না। কিন্তু মারিয়া প্রথমদিন থেকেই ক্লাস করছে বিধায় বেশ কয়েকজনের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তুবা ছোটবেলা থেকেই খুব কম মানুষের সাথে মেশে। তাই যেচে কারো সাথে বন্ধুত্ব করা হয়ে ওঠে না। তবে মারিয়ার সাথে থাকতে থাকতে কিছুদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়ে যায় তুবার। কয়েকজনের সাথে ভালো বন্ধুত্বও হয়ে যায়। লিহা, নামিরা, তামান্না এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে কথাবার্তায় যাদেরকে অহংকারী এবং সৌন্দর্যের দম্ভ আছে বলে মনে হয়েছে তাদেরকে তুবা এড়িয়ে চলে সবসময়।
মারিয়ার সাথে সেই জমজ দুইবোনেও ভালোই কথা হয়। সেই সূত্রে তুবাও কথা বলেছে দুয়েকবার। একজনের নাম সাবিহা আরেকজনের নাম রাইসা। ওদের কথায় যদিও অহংকারপূর্ণ কিছু ছিলো না। থাকবেই বা কেন ওরাও তো বোধহয় তুবার মতোই অসুন্দর। কিন্তু ওদের ঐ কভারড পোশাক তুবার ভালো লাগেনি। এজন্যই হাই-হ্যালোর বাইরে তেমন কোনো আলাপ হয়নি ওদের সাথে। ক্লাস গ্যাপের সময়গুলোতে মারিরা, তামান্না, নামিরা, লিহা এদের সাথে গল্পগুজবে সময় কেটে যায় তুবার।
মাঝেমধ্যেক্লাসের বাইরে ক্যাম্পাসে বা ক্যান্টিনে গেলে লিজার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়। সবাই একসাথে আড্ডা দেয়। তবে তুবার যে চার-পাঁচ বান্ধবী আছে তাদের প্রায় সবারই বয়ফ্রেন্ড আছে বিধায় সবার একসাথে রোজ আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠে না। তবে গ্রুপ স্টাডির সময় সবকজনই একসাথে গোল হয়ে বসে পড়ে। আবার পড়ার ফাঁকেফাঁকে আড্ডাও চলে। এসব আনন্দমুখরতার মাঝেও যখন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গাছতলায় বা ক্যান্টিনে কোনো প্রেমিক কাপলের খুনসুটি আর আড্ডা চোখে পরে তখন অজান্তেই বুকের বা পাশটাতে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভূত হয় তুবার। মনের কোনে একচিলতে আফসোস উঁকি দেয়, "আমি যদি সুন্দরী হতাম আমারও হয়তো একটা সুন্দর বয়ফ্রেন্ড থাকতো। এই যে মেয়েরা প্রেম করছে এরা যদি এদের বয়ফ্রেন্ডকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নাও পায়, তবুও মনের মতো কাউকে স্বামী হিসেবে হয়তো অবশ্যই পাবে। কিন্তু আমার মতো কালো মেয়ের জীবনে না আছে বয়ফ্রেন্ড আর না হবে সুন্দর সুদর্শন কোনো স্বামী।"
এভাবেই ভার্সিটি লাইফের প্রথম দু'মাস কেটে যায় তুবার। প্রথম দিনে তুবাকে ইনসাল্ট করা সেই ম্যাম যেই স্যারের পরিবর্তে ক্লাস নিতেন ঐ স্যার ক্লাস নিতে এসেছেন আজ। বরাবরের মতোই মারিয়া আর তুবা পাশাপাশিই বসেছে।
স্যারকে দেখে বেশ ভালোই মনে হলো তুবার কাছে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, স্মার্ট বিহেভিয়ার, দেখতেও বেশ সুন্দর। ফর্সামুখে খোঁচাখোঁচা চাপ দাড়ি। অনেক সুন্দর করে পড়া বুঝাতে পারেন উনি। প্রথম দিন ক্লাসে এসেছেন উনি আজ তাই প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন। আমি "ড. জাভেদ কায়সার" তারপর ভার্সিটিতে নিজের পেশাগত অবস্থান ও পদ বললেন। এরপর স্টুডেন্টদের সবার পরিচয় জেনে নিলেন একে একে। এরপর অল্প কিছুক্ষণ পড়িয়ে ঐদিনের মতো চলে গেলেন স্যার।
এই স্যারের ক্লাস বেশ ভালোই লাগছে তুবার কাছে। পড়ানোর মাঝেমাঝে প্রায়ই স্টুডেন্টদের কাছে পড়া বিষয়ক প্রশ্ন করেন, কিন্তু না পারলেও অপ্রাসঙ্গিক কোনো মন্তব্য করেন না। সেই ম্যামের মতো তো নয়ই।
সপ্তাহখানেক ক্লাস নেয়ার মাঝেই স্টুডেন্টদের সাথে জাভেদ স্যারের বেশ ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে। একদিন স্যার পড়াচ্ছিলেন -- এক পর্যায়ে সেই জমজ দুই বোনের মধ্যথেকে সাবিহাকে পাঠ্য অধ্যায় থেকে একটা প্রশ্ন করলেন,
-এই যে... তুমি দাঁড়াও ; কী যেন নাম?
-জি স্যার, সাবিহা।
-Nice Name. হ্যা সাবিহা! তুমি কি বলতে পারবে? থার্মোস্ফিয়ারের অবস্থান কোথায়? এবং এখানকার তাপমাত্রা কেমন হয়?
সাবিহা আস্তে করে উত্তর দিলো
-জি স্যার।
-বলো তাহলে
-থার্মোস্ফিয়ারের অবস্থান হচ্ছে মেসোস্ফিয়ারের ঠিক উপরের অঞ্চলে।
স্যার বললেন,
-আরেকটু জোরে বলো শুনতে পাচ্ছি না।
সাবিহা তার উত্তরটা আবার রিপিট করল এবং বলল,
-এ অঞ্চলে সর্বোচ্চ ১২০০⁰ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা হয়।
স্যার বললেন,
-সঠিক উত্তর। প্রথমবার খুব আস্তে বলেছো তো তাই ক্লিয়ার শুনতে পাইনি।
এরপর স্যার সাবিহাকে আরো কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ও সবগুলো ঠিকঠিক উত্তর দিলো। তারপর রাইসাকেও প্রশ্ন করলেন কয়েকটা। সেও ঠিকঠাকভাবে উত্তর দিলো।
স্যার বললেন,
-আচ্ছা বোসো।
গত ক্লাসগুলোতে স্যার অনেক ছাত্রীকেই বিভিন্ন প্রশ্ন ধরেছেন। কিন্তু সাবিহা-রাইসার মধ্যথেকে কাউকে এ প্রথম দাঁড় করানোয় সবাই বেশ আগ্রহের সাথে ওদের দিকে তাকিয়েছে। কারণ এমনিতে ওরা দুজন ক্লাসের অন্যদের সাথে খুব বেশি মেশে না। তারওপর গ্রুপস্টাডি বা আড্ডায়ও ওদের পাওয়া যায় না। তাই সবাই মনে ধরেই নিয়েছে ওরা বোধহয় স্টুডেন্ট হিসেবে অতটা ভালো না। তাই সাগ্রহে সবাই শুনছিলো ওরা উত্তর দিতে পারে কি পারে না।
একটুপর স্যার আবার বললেন,
-আচ্ছা সাবিহা! যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলি...
-জি স্যার বলুন,
-ইসলামে পর্দা একটা কম্পোলসারি বিষয় তা আমি জানি। তোমরা এই তরুণ বয়সে ইসলাম মেনে চলছো, ভার্সিটিতে পড়েও বোরখা পরিধান করে ক্লাস করো এটা ভালো। কিন্তু আমি যতদূর জানি ইসলামে নিকাব পড়াটা বাধ্যতামূলক না। ইসলামে এত কঠোরতা নেই। এটা ঐচ্ছিক বিষয়। সুতরাং তোমরা বোরখা পড়ে মুখ খোলা রাখতে পারো। এতে করে গরমে কিছুটা কম কষ্ট হবে।

"কালো মেয়ে"
৪.
স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই ওদের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকালো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সাবিহা। প্রতিউত্তরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনুপল বিলম্বে ছোট আওয়াজে উত্তর দিলো,
-স্যার আমাদের এতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা এভাবেই অভ্যস্ত।
-হ্যা অভ্যস্ত হয়ে গেলে তেমন একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে মুখমণ্ডল এবং হাতের কবজি খোলা রাখা ইসলামের জায়েজ আছে। তাই আমি তোমাদেরকে সহজ অপশানটা বললাম এই আর কি।
পাশ থেকে রাইসা বলল,
-স্যার, যদি অনুমতি দেন, বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে বলি?
-হ্যা অবশ্যই!
-স্যার, অধিকাংশ স্কলারদের মতে মুখ ঢেকে রাখাও ফারজের অংশ, খোলা রাখার যে অনুমতি আছে, ওটা একান্ত প্রয়োজন হলে, যেমন ধরুন পাসপোর্ট বা রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজের ছবি তুলতে হচ্ছে তখন মুখ না খুলে তো ছবি তোলা যাবে না, এরকম ক্ষেত্রে বৈধ। সর্বাবস্থায় নয়। যদিও কিছু কিছু স্কলার বলেন, সর্বাবস্থায় বৈধ। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআনের সুরা নুর এর ৩১ নম্বর আয়াতের একটা অংশ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا অর্থাৎ "যতটুকু প্রকাশমান তা ব্যতীত মু'মিন নারীরা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে" এটাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের মতে এখানে "যতটুকু প্রকাশমান" বলতে মুখ এবং হাতের কবজি খোলা রাখাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু স্যার, আমাদেরকে এর সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে হলে দেখতে হবে এই কুরআন যেই মহামানবের ﷺ উপর নাযিল হয়েছিলো তিনি এর ব্যাখ্যাটা কীরকম বুঝেছেন এবং তার পরিবারের নারীদেরকে তিনি কীরকম পর্দা করতে বলেছেন। আর সেটা দেখলে আমরা দেখতে পাবো তারা আমাদের থেকেও অনেক বেশি কভারাপলি বোরখা, নিকাব, বড় ওড়না এবং মোজাসহই পর্দা করতেন। মুসলিম নারী হিসেবে তারাই আমাদের আদর্শ।
বলে, একটু থামলো রাইসা।
স্যার বললেন,
-বিষয়টা এরকম? জানতাম নাতো! তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো এই খোলা রাখার মতটা সার্বক্ষণিক ভাবে সঠিক নয় তাইতো?
-স্যার আমিতো স্কলার নই। তবে আমার দুটো মত সম্পর্কেই অল্পবিস্তর পড়াশুনা আছে। আমরা যদি সেসকল স্কলারের কথাও ধরি, যারা মুখ এবং হাতের কবজি খোলার রাখাকে জায়েজ বলেছেন। তারাও কিন্তু কেউ বলেননি যে এটা করা উত্তম। তারাও ঢেকে রাখাকেই উত্তম বলেছেন। ব্যাপার‍টা অনেকটা ফার্স্টক্লাস মার্ক আর টেনেটুনে পাশ মার্ক এর মতো। আমার যদি একটু কষ্ট করে হলেও ফার্স্টক্লাস মার্ক পাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে কেন আমি সেটা করবো না স্যার?
-গুড পয়েন্ট! আসলেই, তুমি ঠিকই বলেছো। বিষয়টা আসলে আমার এভাবে বিস্তারিত জানা ছিলো না। ধন্যবাদ তোমাকে।
একটুপরে ক্লাসের টাইম শেষ হয়ে যাওয়ায় স্যার চলে গেলেন।
স্যারের মতো অন্য স্টুডেন্টরাও রাইসার বলা কথাগুলো শুনছিলো। কিন্তু অন্যরা তেমন একটা গুরুত্ব দিলো কিনা ঠিক বোঝা গেলো না। স্যার চলে যাবার পর, সবাই অভ্যাসমতো গল্পগুজবে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু তুবা যেন আনমনে কিছু একটা ভাবছে। মারিয়া, লিহা ও তামান্নার সাথে গল্প করছিলো। তুবাকে চিন্তিত দেখে মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
-কী রে তুবা? কী ভাবছিস এতো?
-আচ্ছা ঐ মেয়ে দুটোর ফেস দেখেছিস কখনো? দেখতে কেমন?
-ওরাতো নিকাব খোলে না কখনো কিভাবে দেখবো? কেন বলতো?
-আমি তো এতদিন মনে করতাম ওরা বোধহয় কালো। তাই নিজেদের অসুন্দর মুখ আড়াল করার জন্যই এই বোরখা নিকাব পড়ে। কিন্তু আজ স্যারকে রাইসা মেয়েটা যেই ব্যাখ্যা শোনালো তাতে তো মনে হয় ওরা আসলেই ধর্ম মানার জন্যই এরকম পোশাক পড়ে।
-কালো না ফর্সা তা জানিনা। কিন্তু ওদের সাথে আমার কথা হয়তো প্রায়ই, ওরা আসলেই অনেক ধার্মিক।
-ওওও আচ্ছা।
ব্যাপারটা নিয়ে তুবার মনে সাময়িক ভাবনার উন্মেষ হলেও তেমন একটা স্থায়ী হলো না। স্বাভাবিক গতিতেই দিনগত হতে লাগলো তুবার। তবে অবচেতন মনেই দিনকেদিন হতাশা আর উদাসীনতার এক অজানা গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে সে। পড়ালেখায়ও মন নেই আগের মতো।
দেখতে দেখতে ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা চলে এলো। সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তুবা পড়াশোনায় বেশ পিছিয়ে আছে দেখে মারিয়া ও তামান্না ওকে কিছু সাজেশান নোট দিলো। সেগুলো নিয়েই পরীক্ষার আগের ক'দিন পড়ে মোটামুটি রকমের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলো।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরেই রেজাল্ট আসলো। রেজাল্ট নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলো তুবা। স্টুডেন্ট হিসেবে বরাবর সে কখনওই খারাপ ছিলো না। S.S.C. তে GPA-5 ছিলো। কিন্তু তার পর কলেজ ওঠার পর থেকে ধীরে ধীরে হতাশা আর হীনমন্যতা বাড়তে থাকে। সেই সাথে সমানুপাতিক হারে কমতে থাকে পড়াশোনার গতি। শেষতক H.S.C. পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষার পরে খুব করে পড়েও GPA-5 আর ধরে রাখতে পারলো না। রেজাল্ট আসলো 4.75। ভার্সিটিতে ওঠার পর এটাই প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল, কিন্তু সেভাবে ভালো প্রস্তুতি ছিলো না ওর। রেজাল্ট আসলো খুবই খারাপ। তুবা ধারণা করেছিলো ওর রেজাল্ট খুব একটা ভালো হবে না। কিন্তু CGPA যে 3 পয়েন্টেরও নিচে হবে তা বুঝতে পারেনি। মারিয়া, তামান্না, নামিরা, লিহা ওদের সবারই রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছে। ভালো হবারই কথা কেননা ওরা পড়াশুনা করেছে নিয়মিত।
কিন্তু সাবিহা আর রাইসার রেজাল্ট দেখে বেশ অবাক হলো তুবা। ক্লাসের মধ্যে সর্বোচ্চ CGPA- 3.82 পেয়েছে দুজন। তাদের একজন হলো সাবিবা! আর রাইসাও খুব বেশি পিছিয়ে নেই, 3.78 !
পরদিন ক্লাসে এসে তুবা দেখলো ক্লাসের অনেকের মুখেই ওর মতো আশ্চর্যের ছাপ। ওরা দুবোন তো ক্লাসে তেমন সাড়াশব্দও করতো, আর গ্রুপস্টাডিতে তো কখনওই দেখা যায়নি ওদের। বাসায় বসে পড়ে পড়ে এতো ভালো রেজাল্ট! ওরা আসলেই অনেক মেধাবী হয়তো। তুবার মনটা কী ভেবেই যেন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো।
কয়েকদিন পরের কথা। তুবা ক্লাসে এসে দেখলো মারিয়া ক্লাসে আসেনি আজ।
বাসায় গিয়ে মুঠোফোনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওর মা খুব অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাই আজ ক্লাসে আসেনি মারিয়া। আগামী কয়কেদিনও আসবে না।
পরদিন তুবা ক্লাসে দেরি করে যাওয়ায় সামনের দিকে সিট পেলো না। বাঁ দিকে গিয়ে রাইসার পাশের সিটে বসলো।

"কালো মেয়ে"
পর্ব ৫ঃ
ক্লাসের ফাঁকে টুকটাক কিছু কথাও হলো রাইসার সাথে। এতো ভালো রেজল্ট করা সত্ত্বেও রাইসার আচরণে কোনো দাম্ভিকতা না দেখে কিছুটা অবাক হলো তুবা। বেশ ভালোই মনে হলো রাইসাকে। এরপর থেকে প্রায়ই রাইসা ও সাবিহার সাথে অল্পস্বল্প কথাবার্তা হয় তুবার। তুবার কিছু কথাবার্তা রাইসার কাছে অদ্ভুত লেগেছে বেশ কয়েকবার। মনে হয়েছে মেয়েটার বোধহয় ধর্মের ব্যাপারে কিছুটা অরুচি আছে। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে কাউকে কিছু বলা ঠিক না বিধায় রাইসা বা সাবিহা কেউই তুবাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি।
কয়েকদিন পর মারিয়া ক্লাসে আসলো। বাঁ দিকে গিয়ে বসলো। তুবাও ওদিকেই বসেছে। পরপর কয়েকটা ক্লাস হওয়ায় আজ তেমন একটা গল্প জমে উঠলো না। তিনটা ক্লাস হওয়ার পর একটা ক্লাস গ্যাপ পাওয়ায় ক্লাস বেশ কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠলো পুরো ক্লাসরুম। একটু পরেই যোহরের আযান শোনা গেলো। আজকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হবে। লাস্ট ক্লাসটা ১. ৪৫ মিনিটে। যেদিন যেদিন এরকম দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হয়, রাইসা ও সাবিহা সেদিন ভার্সিটিতে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত কমন রুমে গিয়ে নামাজ আদায় করে। দুপুরবেলা কমন রুম প্রায় খালিই থাকে। নিরিবিলি পরিবেশে সাইডব্যাগে করে আনা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে দুবোন।
সাবিহা রাইসাকে বলল,
-রাইসা, ক্লাস শুরু হতে এখনো প্রায় চল্লিশ মিনিট বাকি। চল নামাজটা পড়ে নিই।
-হ্যা চল।
বলে উঠে দাঁড়ালো রাইসা। মারিয়া বললো,
-তোমরা কোথায় নামাজ পড়বে?
-কমন রুমে। ওখানে আরো কয়েকজন আপুও নামাজ পড়তে আসেন।
-আমিও যাবো তোমাদের সাথে।
-হ্যা, এসো তাহলে। আমাদের জায়নামাজ বেশ বড় আছে, তোমারও জায়গা হয়ে যাবে।
এরপর তিনজনে মিলে কমন রুমের দিকে গেলো।
তুবা তখন পিছনের দিকে গিয়ে লিহা ও তামান্নার সাথে গল্প করছিলো বলে খেয়াল করেনি যে মারিয়া ক্লাসের বাইরে গেছে। কিছুক্ষণ পর নিজের সিটে এসে দেখলো মারিয়া ক্লাসে নেই । নামিরাকে জিজ্ঞেস করলো,
-মারিয়া কই রে?
-ও তো বোধহয় সাবিহাদের সাথে কমনরুমে গেলো।
-এই সময়ে কমনরুমে!
-নামাজে যাচ্ছে বলল।
-ওওও আচ্ছা।
তুবার মনে পড়লো এর আগেও যেদিন যেদিন দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হয়ে সেদিন ওরা দুই বোন কমন রুমে গিয়ে নামাজ পড়ে। কিন্তু মারিয়াকে তো কখনো নামাজে যেতে দেখিনি! প্রশ্ন জাগে তুবার মনে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, কমন রুমের দিকে যায় তুবা।
গিয়ে দেখলো, মারিয়ার নামাজ পড়া শেষ। কিছুটা তাচ্ছিল্যস্বরে মারিয়াকে বলল,
-কীরে মারিয়া আজ হটাৎ নামাজ পড়তে এলি?
-আম্মু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করছি রে। আম্মুর জন্য দুয়া করছি। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে নাকি?
-না এখনও শুরু হয়নি। ট্রিটমেন্ট তো চলছে, চিন্তা করিস না আন্টি সুস্থ হয়ে যাবেন।
সাবিহা আর রাইসারও নামাজ শেষ। তুবার কথা শুনে বললো,
-তুমিও নামাজ পড়বে তুবা?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় তুবা। মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলে,
-না, আসলে তোমরা আসছিলে না তো, তাই খুঁজতে চলে এলাম।
কী ভেবেই যেন তুবা একটু থেমে রাইসাকে প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা আল্লাহ কি যে কারো দুআ কবুল করেন?
-হ্যা, দুআ কবুল হওয়ার কিছু নিয়মকানুন আছে সেগুলো মেনে দুআ করলে কবুল হবে।
কথাটা বলে, ঠিক করে বাঁধার জন্য মুখের নিকাবটা খুললো রাইসা।
রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে তুবা যেন আকাশ থেকে পড়লো! এতো সুন্দরও কি মানুষ হয়? গল্প উপন্যাসের ডানাকাটা পরীর রূপের বর্ণনা তুবা অনেক পড়েছে, গ্ল্যামার জগতের সুন্দরী মডেল অভিনেত্রীদের কৃত্রিম নিখুঁত সৌন্দর্যও অনেক দেখেছে। কিন্তু রাইসা যেন গল্প উপন্যাসের পরীর রূপের থেকে বর্ণনাতীত রূপসী! মডেল অভিনেত্রীদের কৃত্রিম সৌন্দর্য যেন রাইসার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের কাছে মিসকিন বনে যাবে! ওর চেহারার লাবণ্যময়তা যেন যে কারো দৃষ্টিকে থমকে দিতে যথেষ্ট! কী অপরূপ মুখাবয়ব! সমুদ্রের মতো সুগভীর দৃষ্টি। শরতের মেঘমুক্ত শুভ্র আকাশের মতো উজ্জ্বল মুখশ্রী। কী এক অদ্ভুত মাদকতা বিরাজমান ঐ মুখে! কিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় তুবা।
রাইসার কথায় সংবিৎ ফিরে পায়।
-কী হলো তুবা?
-হ্যা!
নিজেকে সামলে নিয়ে তুবা বলল,
-তুমি এত্তো সুন্দরী! আমি ভাবতেও পারিনি। আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তুমি রাইসা! সাবিহাও কি তোমার মতোই সুন্দরী?
-আমরাতো জমজ। দেখতে প্রায় একইরকম, আলহামদুলিল্লাহ! তবে তুমি একটু বেশিই প্রশংসা করছো।
-বেশি আর কী করলাম? তোমার সৌন্দর্যের তুলনায় নেহাত অল্পই বললাম।
মারিয়া বলল,
-তুবা! তুই আবার সৌন্দর্য নিয়ে পরলি?
-তুইও তো যথেষ্ট সুন্দরী মারিয়া। আমার মতো কালো হলে বুঝতি কালো মেয়েদের কাছে এটা কত কাঙ্ক্ষিত বস্তু। আমাদের কষ্টটা তোরা কখনওই বুঝবি না।
কথাটা বলে, মৃদু কৃত্রিম হাসি দিয়ে মুখের মলিনতা আর মনের হতাশার মেঘটা আড়াল করার বৃথাচেষ্টা করলো তুবা।
রাইসা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
-যেরকমভাবে বলছো, তুমি কিন্তু সেরকম কালো নও। আর কালো বা ফর্সায় কী আসে যায় তুবা? গায়ের রঙ বা সৌন্দর্যে দিয়ে মানুষের বিচার করাটাই বা কতটা যুক্তিসংগত?
-যুক্তিসংগত নয়। কিন্তু আমাদের সমাজের মানুষেরা তো সেটাই করে।
-সমাজের মানুষেরা কী দিয়ে বিচার করে সেটা কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেখতে হবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা কী দিয়ে মানুষকে বিচার করেন।
-কী দিয়ে মানুষকে বিচার করেন তিনি?
বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুবা।
-শোনো, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন¹ " إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ ٱللَّهِ أَتْقَىٰكُمْ" অর্থাৎ, "তোমাদের মধ্যথেকে আল্লাহর নিকট তারাই সবথেকে শ্রেষ্ঠ, যারা আল্লাহকে অধিক ভয় করে"। এর মানে হচ্ছে, কে ধনী কে গরিব, কে ছোট কে বড়, কে আরব কে অনারব, কে কালো কে ফর্সা কে শ্যামলা, কে দেখতে সুন্দর কে অসুন্দর, এসব কোনোটাই আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে কে তাকে বেশি ভয়, কে তার বিধিনিষেধগুলো কতটা ভালো ভাবে পালন করে সেটা।
বেশ অবাব ভঙ্গিতে আগ্রহভরে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। সাবিহা নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করছিলো। জায়নামাজ ব্যাগে ঢুকিয়ে রাইসাকে বললো,
-সেই হাদিছটার কথাও বলা যেতে পারে, যেখানে স্পেসিফিকভাবে চেহারা ও শরীরের কথা বলা হয়েছে!
হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে রাইসা বলল,
-ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে ওটা বলা যাবে। এখন ক্লাসে যাই চলো।
তুবা বলল,
-একটু দেরি হলে কিছু হবে না। আমি শুনতে চাই, কী বলা হয়েছে সেই হাদীছে?
মুচকি হেসে রাইসা বলল,
-শোনো তাহলে, "রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন², আল্লাহ তোমাদের শরীরের দিকে দেখেন না, তিনি তোমাদের চেহারার দিকেও দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর! অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষের শরীর বা চেহারার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে বিচার করেন না। তিনি মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য দেখে মানুষকে বিচার করেন। যাদের অন্তর হিংসা, বিদ্বেষ আর কলুষতা থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস আর তার বিধিনিষেধ মেনে চলার মানসিকতায় সজ্জিত, সে-ই আল্লাহর কাছে অগ্রগণ্য!
রাইসার কথাগুলো শুনে চিন্তার জগতে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো তুবা। আল্লাহর ব্যাপারে এতদিনের সংশয় যেন ওলটপালট হয়ে যেতে লাগলো। একটা সুধারণার মৃদু বাতাস এসে আনমনা করে দিয়ে গেলো ওকে।
চলবে...
1. সুরা হুজরাত, আয়াত : ১৩
2. সহিহ মুসলিম, হাদীস নং : ২৫৬৪



"কালো মেয়ে"
পর্ব ৬ঃ
রাইসার দিকে তাকিয়ে তুবা বলল,
-আমি এতদিন জানতাম না মানুষকে বিচার করার ব্যাপারে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গিটা এতো সুন্দর! কেউ আমাকে কখনো এভাবে বলেনি। শুধু কটাক্ষ আর কটুমন্তব্যই করে এসেছে সবাই। আর সেগুলো আমার হতাশাই বৃদ্ধি করেছে বারংবার।
-এখন তো জানলে, এখন থেকে আর হীনমন্যতায় ভুগবে না কখনো। চলো তাহলে ক্লাসে যাওয়া যাক।
-হ্যা চলো।
এরপর ক্লাসে গিয়ে বসলো সবাই। স্যার এসে পড়ানো শুরু করেছেন। সবাই স্যারের লেকচার শুনছে। কিন্তু তুবার মন নেই স্যারের কথায়। অবচেতন মনে নিজেকে প্রশ্ন করছে সে, আশেপাশের মানুষগুলোর যে দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনকে বিষিয়ে তোলে, তা পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমি সবসময় কামনা করে এসেছি, আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেছেন, তিনি মানুষকে ঠিক সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন! কতইনা ন্যায়পূর্ণ তার দৃষ্টিভঙ্গি! আর আমি কিনা এতদিন সেই সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারেই খারাপ ধারণা পোষণ করতাম? তিনিতো তার সৃষ্টির ব্যাপারে ন্যায়বান, কিন্তু আমি তার সৃষ্টি হয়েও স্রষ্টার প্রতি কি একটুও ন্যায়পূর্ণ আচরণ করতে পেরেছি? কেমন একটা অস্থিরতা শুরু হয় তুবার মনে। চিন্তাজগতে দ্রুতগতিসম্পন্ন কোনো এক সাইক্লোন যেন ঝড়োবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। যে বাতাস ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে এতদিনের ক্ষোভিত অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে, এতদিনের হতাশাব্যঞ্জক অভক্তিকে, নিজ সত্তাকে অহেতুক আড়াল করার ভুল বিশ্বাসকে! সেই সাথে মনে উঁকি দিতে লাগলো নতুন কিছু প্রশ্ন। আবেগ যেন বিবেকের কাছে শর্ত আরোপ করতে লাগলো, "যদি এগুলোর সমাধান আমাকে দিতে পারো আমি অতীতের সব অনুরাগ ছেড়ে, সব অভিযোগ ভুলে ঐ মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সপে দেবো। তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে, জীবনের শান্তি খুঁজে নেবো।"
ক্লাস শেষ হওয়ার পর তুবা রাইসাকে বলল,
-রাইসা! আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো,
-হ্যা, বলো,
-মানুষকে বিচার করার ব্যাপারে আল্লাহর মাপকাঠি সত্যিই অসাধারণ এবং নিঃসন্দেহে তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু মনে হটাৎ কিছু প্রশ্ন জাগলো, আল্লাহ কেন তার সৃষ্ট মানুষের মাঝে এতো বৈষম্য করলেন? তিনি কি সবাইকে একইরকম বানাতে পারতেন না? তাহলে তো আর ধনী-গরিব, সাদাকালো বা সুন্দর অসুন্দরের এতো ভেদাভেদ থাকতো না। কিছু মনে কোরো না রাইসা, আমি আসলে ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানিনা।
-না না মনে করার কী আছে? শোনো তুবা! আল্লাহ বলেছেন এই এই দুনিয়াটা আমাদের জন্য একটা পরীক্ষাক্ষেত্র। তিনি দেখতে চান কে আমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।³ যেহেতু তিনি ন্যায়বিচারক সেহেতু তিনি প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে ঠিক সেভাবেই বিচার করবেন যে ধরণের প্রশ্নপত্র তিনি মানুষকে দেবেন। এটাই তো ন্যায়বিচার তাই না?
-হ্যা ন্যায়বিচার তো এটাই! কিন্তু সেটার পলিসিটা কিরকম একটু বুঝিয়ে বলবে?
-ধরো কেউ একজন অনেক ধনী। এই ধনদৌলতই হচ্ছে তার জন্য পরীক্ষা! যে, সেই ব্যক্তি এতো প্রাচুর্য পেয়েও আল্লাহকে ভুলে না গিয়ে তার দাসত্ব মেনে নিলো কিনা। পৃথিবীতে আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চললো কিনা। সেই ধনদৌলত দিয়ে গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করলো কিনা। আবার ধরো, কেউ একজন অতি দরিদ্র। প্রতিদিনকার খাবার যোগাড় করতেই তার কষ্ট হয়, বিত্তবৈভব তো কল্পনাতীত। এই দারিদ্রতাই তার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা! যে, সেই ব্যক্তি এতো দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর উপর ভরসা করে, নিজের দারিদ্রতার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিতে পারলো কিনা। জীবনে আল্লাহর অবাধ্য না হয়ে, দারিদ্র্যতা দূর করতে অসৎপথে না গিয়ে সৎপথে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করলো কিনা। এখন যেহেতু তার বিত্তবৈভবের প্রাচুর্যতা নেই সেহেতু সে এই বিষয়টার জবাবদিহিতা থেকেও মুক্ত আবার যে ব্যাক্তি ধনী, সে দারিদ্যতার কারণে ইমানহারা হয়ে যাওয়ার আশংকা থেকে মুক্ত, কিন্তু তাকে দেয়া সম্পদের ব্যাপারে তাকে হিশেব দিতে হবে যে সেগুলোকে সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে ব্যয় করেছে কিনা। ঠিক অনুরূপভাবে ধরো আল্লাহ কোনো কোনো মেয়েকে অত্যাধিক সৌন্দর্য দান করেছেন এটাও যেমন তার জন্য পরীক্ষা আবার কাউকে কালো বা অসুন্দর করেছেন এটাও তার জন্য পরীক্ষা।
কথাগুলো বলে, একটু থামলো রাইসা।
খুব মনোযোগ দিয়ে সাগ্রহে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ আসতেই, আরো বিস্তারিত শোনার তৃষ্ণা অনুভব করলো সে।
-বিত্তবৈভব আর দারিদ্রের ব্যাপারটা বুঝলাম কিন্তু... সুন্দর-অসুন্দরের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। একটু ক্লিয়ার করে বলবে?
-একটা কথা নিশ্চই শুনে থাকবে, "অহংকারীদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।"
-হ্যা শুনেছি,
-তাহলে দেখো, যাকে আল্লাহ সৌন্দর্য দিয়েছেন, তার জন্য পরীক্ষাটা হচ্ছে, সে আল্লাহর এই অনুগ্রহ পেয়ে আল্লাহর প্রতি আরো বেশি কৃতজ্ঞ হলো নাকি অহংকারী হয়ে গেলো। আল্লাহর সব বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে ইসলাম মোতাবেক জীবন পরিচালনা করলো নাকি সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে বিভিন্ন পাপের দিকে পা বাড়ালো। পক্ষান্তরে যাকে আল্লাহ সৌন্দর্য দেননি বা কম দিয়েছেন তার জন্যও এটা এভাবে পরীক্ষা যে, সে এই কারণে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি নাখোশ হয়ে তার অবাধ্য হয়ে যায় নাকি আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে ধৈর্যধারণ করে। যদি সে ধৈর্যধারণ করে এবং আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে তাহলে আল্লাহর পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হবে। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য। রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,⁴ "মুমিনের ব্যাপারটা বড়ই চমৎকার! যখন তার সাথে ভালো কিছু ঘটে, তখন সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে, আর এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যখন তার সাথে (বাহ্যিক দৃষ্টিতে) খারাপ কিছু ঘটে, তখন সে ধৈর্যধারণ করে। আর এটাও তার জন্য কল্যাণকর।” আর আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,⁵ "যদি তোমরা আমার অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করো আমি তা আরো বাড়িয়ে দেবো।" আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন,⁶ "নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন"
অছেদ্য এক আবিষ্টতা নিয়ে রাইসার কথাগুলো শুনছিলো তুবা। মনের মধ্যথেকে সকল হতাশা আর সংশয়ের পতঙ্গ যেন একে একে মুষড়ে পরছে রাইসার ছোড়া পবিত্র তীরাঘাতে। শুরু হতে লাগলো বিবেকের নব আহ্বান! এমন সুন্দর, নির্মল, ন্যায়পূর্ণ এক জীবনব্যস্থা থেকে, এমন ন্যায়বান প্রভুর দাসত্ব থেকে আমি এতদিন কিভাবে দূরে ছিলাম? কত সুন্দর আল্লাহর ভাবনাগুলো! যিনি আমার সমাজের মানুষগুলোর মতো একচোখা নন। যিনি সৃষ্টিজগতের কোনোকিছুর মতোই নন। সেই মহান আল্লাহর থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে ছিলাম এতদিন? অপরাধবোধে চোখদুটো ভিজে উঠলো তুবার।
সাবিহা বলল,
-দেখো তুবা! আজকে তোমার গায়ের রঙ একটু অনুজ্জ্বল বলে তোমার হয়তো খুব আফসোস হয়, তোমার হয়তো মনে হয় ফর্সা হলেই ভালো হতো। কিন্তু কে বলতে পারে আল্লাহ হয়তো এর মধ্যেই তোমার জন্য কল্যাণ রেখেছেন।
-সেটা কিরকম?
কাপা কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো তুবা।
-পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারাতে আল্লাহ বলেছেন,⁷
“হয়তো তোমরা কোন একটি বিষয় পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর নয়। পক্ষান্তরে কোনো একটি বিষয় অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুত, আল্লাহই সব জানেন আর তোমরা জানো না।” তাই আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও। যদি তিনি তোমাকে কোনো কাঙ্ক্ষিত বস্তু না দিয়ে থাকেন, তবে সেটা তিনি তোমার ভালোর জন্যই করেছেন। ধরো তুমি এখন ভালো চরিত্রের মেয়ে, কিন্তু যদি তোমার অনেক সৌন্দর্য থাকতো, হতে পারতো তুমি সেই সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে অনেক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে, প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপের পথে যেতে। তাহলে, আল্লাহ তোমাকে সেই সৌন্দর্য না দিয়েই তোমার মঙ্গল করেছেন। শয়তানকে ওয়াসওয়াসা দেয়ার সুযোগ দিয়ো না তুবা। আজ যদি তুমি অসুন্দর হওয়ার ব্যাপারে হতাশ হয়ে অভিযোগ তোলো, কেন আল্লাহ আমাকে সুন্দর বানালেন না? তাহলে তো তুমি ভুলে যাবে আল্লাহ তোমাকে এমন অনেক অনুগ্রহ দিয়েছেন, যা তোমার আশেপাশের অনেককেই দেননি। আল্লাহ তোমাকে দেখার জন্য দুইটা চোখ দিয়েছেন, অথচ কোটি কোটি মানুষ চোখে দেখতে পায় না। তুমি পা দিয়ে হাঁটতে পারো অথচ কতশত মানুষ আজ পঙ্গু। কেউ হয়তো জন্মগতভাবেই এই অনুগ্রহ পায়নি, কেউবা আবার পেয়েও হারিয়েছে কোনো দুর্ঘটনাবশত। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন,⁸ “যদি তোমরা আল্লাহর নি‘আমত গণনা করো, তবে তার সংখ্যা গুনে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই যালিম এবং অকৃতজ্ঞ!"
তাই, আমরা যাতে অন্যদের সৌন্দর্য দেখে নিজেদের নিয়ে হতাশায় না ভুগি, সেজন্য আল্লাহ বলেছেন,⁹ “তুমি কখনো চোখ মেলে তাকিও না ঐসবের প্রতি যা আমি তাদের বিভিন্ন দলকে পার্থিব জীবনে উপভোগের জন্য সৌন্দর্য হিসাবে দিয়েছি। যাতে আমি সে ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমাকে দেয়া তোমার রবের অনুগ্রহই হলো সবচেয়ে উত্তম। সবচেয়ে বেশি স্থায়ী।” সুতরাং আমরা মানুষেরা যদি অকৃতজ্ঞ না হয়ে আল্লাহর সেই অনুগ্রহগুলোর কৃতজ্ঞতা আদায় করি, আল্লাহর দ্বীন ইসলাম অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে সাজাই, তাহলে তিনি আমাদেরকে পরকালের জাহান্নামের ভয়াবহ কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন, এবং চিরস্থায়ী জান্নাত দান করবেন।
একটু থেমে, সামনে বসে টলমল চোখে, তন্ময় হয়ে কথা শুনতে থাকা তুবার কাঁধে একটা হাত রেখে সাবিহা আবার বললো,
-সুতরাং, বোন আমার! এসব হতাশাকে ছুড়ে ফেলে আল্লাহ যেমন চান, তেমনি তার একজন অনুগত বান্দী হয়ে যাও। তার ইচ্ছাকে হাসিমুখে মেনে নাও। আল্লাহর ইবাদাতে মনোনিবেশ করো। সালাত-সিয়াম, ফারজ পর্দাসহ তার দেয়া সব বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করো। তাহলেই কেবল তুমি সব সমস্যার সমাধান পাবে। মানসিক প্রশান্তি হবে। হতাশা থেকে মুক্তি পাবে। সফল আর সন্তুষ্টির জীবন পাবে।
রাইসা ও সাবিহার কথাগুলো শুনে আবেগ আর অনুশোচিত চিত্তে চোখে পানি চলে এসেছিলো তুবার। সবিশেষে সাবিহার এমন আবেগঘন আহ্বানে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো তুবা। টপটপ করে গাল বেয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুরেখা। রাইসা শান্তনা দিয়া বললো,
-কেঁদো না তুবা। আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য তার দিকে ফিরে আসার রাস্তা কখনো বন্ধ করেন না।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তুবা বলল,
-আসলে আমি একটু কালো হওয়াতে বুঝতে শেখার পর থেকেই অনেক হতাশায় ভুগি। সেখান থেকেই আল্লাহ বা ধর্মের প্রতিও কিছুটা সংশয় জন্মায়। ইতঃপূর্বে আমার এসকল হতাশার ব্যাপারে ইসলামের এতো সুন্দর অভিব্যক্তি সম্পর্কে আমি জানতাম না। এতোদিনের হতাশা আর সংশয়ের সেই জমাট বাধা পাথরটা আজ তোমরা সরিয়ে দিয়েছো। এজন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
বলে, নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো তুবা।
সাবিহা নিজের হাতে তুবার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলরেখাটা মুছে দিলো। হাতমোজা ভেদ করে চোখের উষ্ণ পানির স্পর্শ অনুভব করলো নিজের আঙুলে।
তুবা বলল,
-আমি এই হতাশাময় জীবন থেকে, সন্তুষ্টির জীবনে পদার্পণ করতে চাই। সংশয় ভুলে আল্লাহর অনুগত হতে চাই। তার দেয়া বিধিনিষেধ মেনে চলতে চাই। তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে?
-অবশ্যই করবো তুবা! আমাদেরও ভালো লাগবে, আমাদের একজন পথভোলা বান্ধবী আমাদের দ্বীনের পথে চলার সাথী হবে। স্বাগতম তোমাকে এই প্রশান্তিময় জীবনব্যবস্থায়।
বলে, তুবাকে আলিঙ্গনপাশাবদ্ধ করে নিলো সাবিহা ও রাইসা।
চলবে...
নোট:
3. সূরা মুলক, আয়াত : ২
4. সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৯৯৯
5. সূরা ইব্রাহীম, আয়াত : ৭
6. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ১৫৩
7. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ২১৬
8. সূরা ইব্রাহীম, আয়াত : ৩৪
9. সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১৩১


"কালো মেয়ে"
পর্ব ৭.
এখান থেকেই শুরু হয় তুবার নতুন পথচলা। তার পরদিনই সাবিহা তুবাকে বেশ কিছু বই উপহার দেয়। একদম ওপরেই ছিলো নামাজ শিক্ষার একটা বই। বইটা দেখে তুবা বেশ খুশি হয়ে বলল,
-এই বইটাই এখন আমার অন্যসবগুলোর আগে দরকার।
-হ্যাঁ, একজন মুসলিমের জন্য সর্বপ্রথম ফারজ কাজ হলো সালাত। এখন যেহেতু তুমি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছো তাই সালাতের ব্যাপারে জ্ঞানার্জনই তোমার জন্য সবথেকে জরুরী। সেই ভাবনা থেকেই এটা দিলাম। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে আমাকে বোলো, কমন রুমে নামাজের সময় প্র‍্যাক্টিক্যালি দেখিয়ে দেবো। কেমন?
-আচ্ছা।
বলে একটা মুচকি হাসি দিলো তুবা। সে হাসির মাঝে আছে একসমুদ্র প্রশান্তি, কৃতজ্ঞতা আর আশা। হাসলে খুব মিষ্টি লাগে তুবার মুখখানি।

সেদনই ওদের কাছ থেকে, ইসলাম সম্বন্ধে-- তাওহীদ-শির্ক, ইমান-কুফরসহ সালাত, সিয়াম সম্পর্কে বেসিক কিছু বিষয় জেনে নিয়েছিল তুবা। এরপর ধীরে ধীরে চিন্তা-চেতনায়, কাজেকর্মে, আচার-আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে তুবার। প্রতিদিন ক্লাসে এসে সাবিহা ও রাইসার পাশেই বসতে শুরু করলো। ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে চলতে থাকে নতুন কিছু জানা আর সেগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। কিন্তু পর্দা করার ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ঝামেলায়ই পড়তে হলো তুবাকে। কী করবে কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তারওপর আবার গরমের প্রকোপ। কিছুটা হতাশ হয়ে রাইসা ও সাবিহার কাছে খুলে বলল ব্যাপারটা।
-আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন নামাজে নিয়মিত। কিন্তু রাইসা আমারতো পর্দাও করা উচিত, এটাও তো ফারজ। কিন্তু আমি কিভাবে তোমাদের মতো এমন আপাদমস্তক ঢেকে চলবো বুঝতে পারছি না। আমার গরমের সমস্যাটা একটু বেশিই। এমনভাবে মাথা-মুখ ঢেকে কিভাবে থাকবো-- ভাবলেই আমার আরো বেশি গরম লাগা শুরু করে। নামাজের ঐ অল্প সময়টাতে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে থাকি তাতেই আমার মাথায় প্রচুর অস্বস্তি লাগে। গরম লাগা শুরু করে। তোমরা দুবোন কত সুন্দর ওড়না-নিকাব পরো।
সাবিহা বলল,
-শোনো তুবা! আমাদের এখানে অনেক গরম ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ এর থেকেও অনেক গুণ বেশি! আর আমরা যারা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী, তারা সেই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য দুনিয়ার এই কষ্টকে সামান্যই আমলে নেবো। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা বলেছেন,¹⁰ "আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার চাপিয়ে দেন না।"
কথাটা আসলেই সত্য। বাহ্যিক ভাবে যদিও আমাদের মনে হয় এই গরম আমাদের জন্য অসহ্য। কিন্তু আমাদেরকে আল্লাহ "অভিযোজন ক্ষমতা" নামক একটা অনুগ্রহ দান করেছেন। যার বলে আমরা যেকোনো অবস্থার সাথে সময়ের পরিক্রমায় নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারি। এজন্যই দেখবে আমাদের এখানকার তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানকার মানুষ ওখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে মানিয়ে নিতে পারছে, আবার ডিসেম্বরে ২০⁰ -২৫⁰ সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেই আমাদের এখানে অনেক শীত থাকে, অথচ ঐ সময় ইউরোপ-আমেরিকাতে মাইনাস তাপমাত্রা থাকে, তবুও এখানকার অনেক মানুষ ঐসময় ঐসব দেশে গিয়ে দিব্যি নিজেদেরকে মানিয়ে নেয়। সুতরাং একটু চেষ্টা করলে তুমিও মানিয়ে নিতে পারবে। এতো আপসেট হওয়ার কিছু নেই, শুধু বিশ্বাস রাখো যেহেতু আল্লাহ তোমাকে হিদায়াতের আলো দিয়েছেন, সেহেতু এই পথের বাঁধা গুলোকেও তিনি সহজ করে দেবেন। আর তাছাড়া আমাদের বুঝতে হবে যে দুনিয়া হচ্ছে পরীক্ষার জায়গা। পরীক্ষা তো একটু কঠিন মনে হবেই। আর নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণের নামই তো ইসলাম।
সাবিহার কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো তুবার কাছে।
রাইসা বলল,
-আর শোনো তুবা, শয়তানের ধোঁকায় পোড়ো না। তুমি এখন দ্বীন প্র‍্যাক্টিস করতে শুরু করেছো তো, শয়তান চাইবে তোমাকে গরমের ভয় দেখিয়ে, "লোকে কী বলবে" এই চিন্তাসহ নানান ভাবনাচিন্তা মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে দ্বীন থেকে দূরে রাখতে। এসবে পাত্তা দিয়ো না। একসাথে পুরোপুরি পর্দা শুরু করবো ভেবে বসে থাকলে মাঝখানের দিনগুলোতে শয়তানকেই সন্তুষ্ট করা হবে। তার চেয়ে বরং আস্তে আস্তে ধাপেধাপে পুরোপুরি পর্দা করার চেষ্টা করতে থাকো। তাহলে, আল্লাহর পথে চেষ্টাটা অন্তত করা হবে।
-কীভাবে করবো? একটু বুঝিয়ে বলো
-প্রথমে যেটা করবে সেটা হচ্ছে, ক্লাসে, বাসায়, বাইরে সবজায়গায়ই লম্বা এবং ঢিলেঢালা জামা পরবে যাতে শরীরের গঠনরূপ বোঝা না যায়, আর মাথায় ওড়না রাখবে সবসময়। কষ্ট হবে, অস্বস্তি লাগবে, গরম লাগবে, মাথা ব্যাথা করবে-- তারপরও মাথা ঢেকে রাখবে, এগুলোই পরবে। আর সালাতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ কর‍তে থাকবে যাতে তিনি তোমার দ্বীন পালনের সমস্ত বাধাবিপত্তি গুলো দূর করে দেন। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় কিছুদিন পরেই তুমি যখন মাথা ঢেকে রাখায় এবং এই পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখনই বোরখা ও নিকাবে আর কোনো সমস্যা হবে না ইন শা আল্লাহ!
রাইসার পরামর্শ বেশ মনে ধরলো তুবার। আসলেই তো আমি এতদিন সবকিছু একসাথে শুরু করবো ভেবে বসে ছিলাম অথচ একটু একটু করে শুরু করলে এতোদিনে অনেকটাই এগিয়ে থাকতাম।

এরপর রাইসা ও সাবিহার পরামর্শ অনুযায়ী নিজেকে পূর্ণ দ্বীনদার একজন মুসলিমাহ হিসেবে প্রস্তুত করতে অধ্যবসায় চালিয়ে যেতে থাকে তুবা। রোজ সে ক্লাসে আসে ফুল স্লিভের জামা পরে, মাথায় ওড়না দিয়ে। সেভাবেই ক্লাস করে। ক্যাম্পাসের এথাসেথা ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস আগে থাকলেও এখন আর নেই। ক্লাস, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি আর যেদিন দুপুর পর্যন্ত ক্লাস থাকে সেদিন রাইসা ও সাবিহার সাথে কমন রুমে গিয়ে সালাত আদায় করা পর্যন্তই তুবার ঘোরাফেরা। মারিয়াও সালাতে যায় ওদের সাথে। তুবা এখন মারিয়াকেও পূর্ণ দ্বীন মেনে চলার পরামর্শ দেয়। রাইসা-সাবিহার দেয়া বইগুলো পড়ে ইসলাম সম্মন্ধে টুকটাক জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। এরপর কুরআন পড়াও শিখতে শুরু করে। দুনিয়ার চোখে অসুন্দরের হীনমন্যতায়, হতাশায় নিমজ্জিত কালো মেয়েটা আল্লাহর দ্বীনের সৌন্দর্যে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে থাকে দিনকেদিন।
দেখতে দেখতে আরো একটা সেমিস্টার কেটে যায়। তুবার রেজাল্টে যদিও আগের থেকে খুব বেশি উন্নতি হয়নি, কিন্তু তুবা এখন আর মানসিকভাবে হতাশায় ভোগে না আগের মতো। তাই মন দিয়ে আরেকটু বেশি পড়লেই সামনে রেজাল্ট ভালো হবে ইন শা আল্লাহ।
রাইসা ও সাবিহার সাথে সম্পর্কটা আগের থেকে গাঢ় হয়েছে। ওদের প্রতি তুবা চিরকৃতজ্ঞ। ওদের উছিলায়ই মেয়েটা প্রশান্তিময় সেই বাতাস খুঁজে পেয়েছে, যার অভাবে হতাশার দাবদাহে অন্তরটা তৃষ্ণার্ত হয়েছিলো এতগুলো বছর।

থার্ড সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। তুবা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলো। এমন সময় সাবিহা ও রাইসাও আসলো লাইব্রেরিতে। তুবার পাশেই গিয়ে বসলো দুজন।
একটু পর ওরা যেখানে বসেছে তার পিছনে এবং ডান পাশের তাকে বই খোঁজার বাহানায় একটা ছেলে একাধিকবার এসে আবার অন্যদিকে চলে গেলো। যাওয়ার সময়ে আড়চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছিলো। বিষয়টা কারোই দৃষ্টি এড়ালো না। তুবা অবশ্য বই পড়ায়ই মনোযোগী ছিলো। সাবিহা রাইসার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলল,
-এই সেই ছেলেটা না?
-হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে!
-তুবার কাছে জিজ্ঞেস কর, কে এটা?
-এখন না, ছেলেটা লাইব্রেরি থেকে বের হোক, তখন জিজ্ঞেস করছি...
ছেলেটা বাইরে যাওয়ার পর তুবাই রাইসাকে বলল,
-রাইসা, একটা বিষয় গত কয়েকদিন ধরে বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কিভাবে বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে ভুল বুঝোনা কিন্তু হ্যাঁ?
-ধুর বোঁকা মেয়ে! ভুল কেন বুঝবো? একজন মু'মিন কখনো মিথ্যা বলে না। কী হয়েছে খুলে বলো
-ঐ ছেলেটাকে দেখলে না? যে এখানে বই খুঁজতে এসেছিলো।
-হ্যাঁ!
-ওর সাথে লাইব্রেরিতেই পরিচয়। নাম রিফাত। দেখতে শুনতে ভালোই। ভদ্রও বেশ। প্রায়ই লাইব্রেরিতে আমার টেবিলের অপোজিটে এসে বই পড়তে বসতো। ক্যান্টিনেও দেখা হয়েছে কয়েকবার। সেই সুবাদে টুকটাক দুএকটা কথাও হয়েছে। কথা শুনে মনে হলো, ছেলেটা বেশ ধার্মিকও। ধর্মীয় জ্ঞান আছে অনেক। সেজন্যই মূলত একটুআধটু কথা বলেছিলাম আর কি। কিন্তু সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে লাইব্রেরিতে বসেই বললো, আমাকে নাকি সে পছন্দ করে। প্রথমে ভেবেছিলাম মজা করছে, আমার মতো কালো মেয়েকে ওর মতো সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে কেন পছন্দ করতে যাবে? কিন্তু পরে সিরিয়াসলিই প্রোপোজ করলো।
-তুমি যেমনটা বলছো তুমি ততটাও কালো নও। আর তোমার মুখটা খুব মিষ্টি তো। আচ্ছা যাক, তারপর তুমি কী বললে?
-আমি বললাম, দেখুন! আমি ছেলে মেয়েদের এসব প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। আমার পক্ষে আপনার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করা সম্ভব না।
-মাশাআল্লাহ, তুবা! সোজাসাপ্টা কিন্তু একেবারে সঠিক উত্তরই দিয়েছো।
-হ্যাঁ, আমি তোমাদের উছিলায় দ্বীন সম্বন্ধে এখন অল্পস্বল্প হলেও তো জানি তাই না? বিয়ে বহির্ভূত এসব প্রেম ভালোবাসা ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু ছেলেটা আমাকে বলল,
-ঠিক আছে। প্রেম করতে হবে না। পড়াশুনা শেষ হলে না হয়, আমরা পারিবারিকভাবে বিয়ে করবো। আর ততদিন বন্ধুর মতো থাকবো একে অপরের সাথে।
-তারপর তুমি কী বললে?
-কিছু বলিনি। সে বলেছে ভেবেচিন্তে পরে যেন জানাই। কিন্তু তারপর আর কথা হয়নি। আজ জানতে এসেছিলো হয়তো, কিন্তু তোমাদেরকে দেখে আর কিছু বলেনি। এই বিষয়টাই তোমাদেরকে জানাতে চাচ্ছিলাম। বিষয়টা মনের ভেতর খটকা লাগছিলো খুব। এরকম বন্ধুত্ব ঠিক হবে?
রাইসা কিছু বলার আগেই সাবিহা বললো,
-মাথা খারাপ তোমার? যেই কারণে বিয়েবহির্ভূত প্রেম নিষিদ্ধ সেই একই কারণে ছেলে-মেয়েদের এমন বন্ধুত্বও নিষিদ্ধ।
সাবিহার এমন দ্রুত উত্তরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তুবা বলল,
-একটু বুঝিয়ে বলো, আমিতো আসলে জানিনা।
এরপর রাইসা বলল,
-শোনো তুবা! তুমি কি মাহরাম এবং নন-মাহরাম সম্বন্ধে জানো?
-হ্যাঁ! রক্তের সম্পর্কের ১৪ জন পুরুষ ব্যাতীত সবাই নন মাহরাম। সাবিহার দেয়া একটা বইতে পড়েছিলাম। কুরআনেও পেয়েছি পরে।
-আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে বিষয়টা বোঝা তোমার জন্য সহজ হবে। শোনো, নন মাহরামদেরকে দেখা দেয়া এবং তাদের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলাও ইসলামে নিষিদ্ধ। তাদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে সেইফ করা ফারজ। কারণ এখান থেকেই ফিতনার সূচনা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,¹¹ "ফিতনা হচ্ছে অন্যায় হত্যার থেকেও কঠিন অপরাধ।" এজন্যই ইমানের হেফাজতের জন্য যেমন নিজের দৃষ্টি সংযত রাখা আবশ্যিক তেমনি যেসব কাজে ফিতনার আশংকা থাকে সেসব থেকে দূরে থাকাও আবশ্যিক। আর এ কারণেই ইসলাম নন-মাহরামদের সাথে দেখা করা ও অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতাকে নিষিদ্ধ করেছে। এধরণের আলাপ থেকেই ধাপেধাপে প্রেমের খোলসে সীমালঙ্ঘন হয়। আর তাছাড়া আমরা তো যিনা ব্যাভিচারকে সবাই ঘৃণা করি, তাই না তুবা?
-হ্যাঁ অবশ্যই! এটাতো নিকৃষ্ট পাপের কাজ!
-হ্যাঁ। তবে তুমি হয়তো জানো না, শুধু অবৈধ দৈহিক মিলনকেই যিনা বলে না। ওটা যিনার চূড়ান্ত পর্যায়। আরো বিভিন্ন ধরণের যিনা রয়েছে। রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,¹² "চোখের যিনা হলো নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করা, কানের যিনা হলো শ্রবণ করা, মুখের যিনা হলো কথোপকথন, হাতের যিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হেঁটে যাওয়া, অন্তরের যিনা হলো আকাঙ্ক্ষা এবং কামনা করা।" তাহলে তুমিই বলো, একজন নন মাহরামের সাথে শারীয়াহ যেই সীমারেখা টেনে দিয়েছে তা লঙ্ঘন করে যখন অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা বলা হবে তখন কি সেটা যিনার অন্তর্ভূক্ত হবে না?
-হ্যাঁ, তাইতো হবে। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমিতো বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখিনি। আর এই হাদীছটাও জানতাম না!
সাবিহা বলল,
-এজন্যই ইমানের দাবী হচ্ছে যেখানে যিনার আশংকা আছে সেখান থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,¹³ "যিনার ধারেকাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই ওটা অশ্লীলতা ও বিপথগামীতা।"
এরপর রাইসা বললো,
-তাহলে, প্রিয় বান্ধবী আমার! এখন কী আর বুঝিয়ে বলতে হবে, কেন শুধু বিয়ে বহির্ভূত প্রেম নয়, এসব বন্ধুত্বও ইসলামে নিষিদ্ধ?
মুচকি হেসে তুবা উত্তর দিলো,
-নাগো, আমার রূপসী বান্ধবীদ্বয়! আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।

চলবে...

নোট:
10. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত : ২৮৬ এবং সূরা মু'মিনুন আয়াত : ৬২
11. সূরা আল বাকারাহ, আয়াত: ১৯১
12. সহিহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৬৯২৫, সুনান আল বাইহাকি: হাদীছ নং- ১৩৮৯৩
13. সূরা আল ইসরা, আয়াত: ৩২


"কালো মেয়ে"
পর্ব ৮;
এমন সময় মারিয়া আসলো লাইব্রেরিতে।
-শাহজাদীরা সবাই তাহলে এখানে বসে গল্প করা হচ্ছে? আর আমি কমন রুম, ক্যান্টিন কোথায় আপনাদেরকে খুঁজে পাচ্ছি না!
মারিয়ার কথা শুনে হেসে দিলো সবাই। সাবিহা জিজ্ঞেস করল,
-কেন? স্যার এসেছে ক্লাসে?
-না। আজকে আর ক্লাস হবে না। চলে গেছে সবাই। তোমরা যাবে না?
-ওওও তাই? হ্যাঁ যাবো তো। রাইসা চল তাহলে। তুবা তুমিও চলো, একা একা বসে থেকে কী করবে?
-হ্যা চলো...

বাসায় আসতে আসতে রাইসা ও সাবিহার আজকের বলা কথাগুলো স্মরণ করছিলো তুবা। সত্যিই ওদের উছিলায় আল্লাহ আমাকে আবারও সঠিক পথ দেখালেন। আল্লাহ ওদের ভালো করুন, কত সুন্দর ভাবে ওরা আমাকে ইসলামের বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলে। আল্লাহ ওদের জ্ঞানকে আরো বৃদ্ধি করে দিন।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালো তুবা। লাইব্রেরি থেকে বেরোনোর সময় কানেকানে বলা সাবিহার কথাটা মনে পড়লো তুবার...
-তুবা, সৌন্দর্য নামক অনুগ্রহটা কেবল গায়ের রঙেই নয়, গড়নেও থাকে। আল্লাহ তোমাকে সেই অনুগ্রহটা দিয়েছেন। আর উভয় সৌন্দর্য হেফাজতে রাখার জন্যই আল্লাহ পর্দার বিধান দিয়েছেন। তাই নিকাব আর বোরখা পরা শুরু করে দাও আল্লাহর নাম নিয়ে। আল্লাহর বিধান মেনে, তার দেয়া অনুগ্রহগুলো হেফাজত করলে, এই বন্ধুত্ব বা প্রেম নামক খুতওয়াতুশশাইত্বন¹⁴ থেকে আল্লাহই তোমাকে হেফাজত করবেন, ইনশাআল্লাহ!

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের মুখে আনমনেই এক চিলতে লজ্জামাখা হাসির রেখা দেখতে পায় তুবা। সত্যিই বলেছে সাবিহা। আমার বোরখা-নিকাব পরেই চলা উচিত। তাছাড়া ওড়না আর ফুল স্লিভের জামায় এখন তো আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন আর কীসের অজুহাত?
যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরদিন ক্লাস শেষে রাইসা ও সাবিহার সাথে মার্কেটে গিয়ে বোরখা ও নিকাব কিনে আনলো তুবা। এরপর থেকে প্রতিদিন এই ড্রেসেই ভার্সিটিতে যায় সে। বাসার সবাই তুবার এই পরিবর্তনে বেশ খুশিই হলো। তুবার মা খুশি হলো বেশি। হবেই বা না কেন? আগে তো মেয়েকে শত বলে কয়েও নামাজ পড়াতে পারতো না। আর এখন মেয়ে নিজে থেকেই নামাজ পড়ে। বোরখা পরে। তাও নিকাব সহ। তুবার দেখাদেখি ওর মাও বাইরে যেতে হলে বোরখা-নিকাব পরে বাইরে যায় এখন। অবশ্য এর পিছনে তুবার ভূমিকা আছে। মা'কে বুঝিয়েছে সে, পর্দা করা কতটা জরুরী। তুবার বাবাও ওর পরিবর্তনে বেশ খুশি।

এভাবেই দিন কাটতে থাকে তুবার। কিছুদিন পর তুবা সাবিহা-রাইসার মতো হাতেপায়ে মোজাও পরা শুরু করলো। হটাৎ দেখলে তিনজনকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যায় ক্লাসের সহপাঠীদের কাছেও। একইরকম কালো বোরখা, কালো রঙের বড় আরাবিয়ান নিকাব, হাতে কালো মোজা, পায়ে কালো কেডস। চোখের দিকে না তাকালে কারো বোঝার সাধ্যি নেই কোনটা সাবিহা বা রাইসা আর কোনটা তুবা।

যেই মেয়েটা একসময় গান, মুভি আর ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। সেই মেয়েটা ভার্সিটিতে উঠে দুটো পরশপাথরের ছোঁয়ায় ইসলামের রঙে রঙিন হয়ে সুন্নাতী জীবনযাপন শুরু করলো। তিনজনে মিলে মাঝেমধ্যে অন্য ক্লাসমেটদেরকে টুকটাক দ্বীনের দাওয়াত দেয়াও চালিয়ে যেতে থাকে। হিদায়াত দেয়ার মালিক তো আল্লাহ। আমরা মানুষেরা আমাদের অবস্থান থেকে অন্তত সাধ্যানুযায়ী চেষ্টাটুকু তো করতে পারি। ওরাও সেটাই চালিয়ে যেতে লাগলো।

দিনেদিনে আল্লাহর ইবাদাতে আরো নিবেদিতা হতে থাকে তুবা। ফারজ সালাতের পাশাপাশি তাহাজ্জুদগুজারওহয়ে ওঠে মেয়েটা। নিয়মিত ক্লাসের পড়া, সেইসাথে ততোধিক গুরুত্ব দিয়ে কোরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা করে সে। অপ্রয়োজনে এখন আর বাইরে বেরোয় না মেয়েটা। এভাবেই নীরবে নিভৃতে হতাশায় ভরা জীবন থেকে বেরিয়ে এসে, আশাচিত্ত দৃঢ় ইমানের একজন মুসলিমাহ হওয়ার প্রয়াস অব্যাহত থাকে তুবার।

দেখতে দেখতে লাস্ট সেমিস্টারের এক্সাম সামনে চলে আসে। থার্ড সেমিস্টারের পর থেকেই রেজাল্টও আগের থেকে ভালো হতে শুরু করে। কিছুদিন পরই ফাইনাল এক্সাম। আরেকটু ভালো করে পড়াশুনা করলেই টোটাল বেশ ভালো একটা CGPA আশা করা যায়। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হতে না হতেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো তুবা। "চিকনগুনিয়া" নামক ভাইরাসজনিত এক জ্বর চারিদিকে মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে শোনা যাচ্ছে। আগের সেই তুবা হলে হয়তো অসুস্থতার জন্য রাগে ক্ষোভে আল্লাহকে যা তা দোষারোপ করতো। কিন্ত এখনকার তুবা তো দ্বীন বোঝে। সে জানে, সুস্থতার মতো অসুস্থতাও আল্লাহর একটি নিআমাত। অসুস্থতার মাধ্যমে আল্লাহ কিছু গুনাহ মাফ করে দেবেন ইন শা আল্লাহ। এটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। ধৈর্যের পরীক্ষা। তাই অধৈর্য হওয়া যাবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যধারণ করতে হবে। কেননা কুরআন বলছে,¹⁵ "যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।" তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে, অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষায় বসলো তুবা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর রহমতে সুস্থও হয়ে গেলো। দু'তিনটা পরীক্ষা অবশ্য একটু খারাপ হয়েছে। তবুও সে একদমই অসন্তুষ্ট নয়। কারণ এটাই হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো। আর মু'মিনদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সর্বদা আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা।

কিছুদিন পর রেজাল্ট আসলো। রেজাল্ট পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো তুবা। CGPA খুব বেশি ভালো না হলেও ফার্স্টক্লাস পয়েন্ট এসেছে আলহামদুলিল্লাহ।

সময়মতো মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গেলো তুবা। আগের বান্ধবীরা একেকজন একেদিকে চলে গেছে। অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে, কেউবা জব করছে। কারো সাথেই তেমন একটা যোগাযোগ নেই তুবার। তবে মারিয়া আর সাবিহা-রাইসার সাথে যোগাযোগ আছে। সাবিহা আর রাইসাকে কি ভোলা যায়? ওদের উছিলায়ই তো হতাশার অতলে হারিয়ে যেতে থাকা মেয়েটা আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। ব্যাকুল হৃদয়ে খুঁজেফেরা প্রশান্তিময় জীবন পেয়েছে। সকল হতাশা আর হীনমন্যতা ভুলে আন্তরিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে।
ওদের দুজনারও বিয়ে হয়ে গেছে। আল্লাহর দয়ায় ওরা ওদের মতোই দ্বীনদার জীবনসঙ্গী পেয়েছে। তুবার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চেষ্টা করছে সেই ফাইনাল পরীক্ষার পর থেকেই। কিন্তু এখনও তেমন আশানুরূপ কিছু হয়নি। গত কয়েকমাসে প্রায় ৮/৯টা সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু একটাও বেশিদূর এগোয়নি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা পরিবার সিভি দেখে কথা এগিয়েছিলো কিন্তু মেয়ে দেখতে এসে তারা তুবাকে পছন্দ করেনি। একেবারে ফর্সা না হলেও তাদের চাহিদা আরেকটু উজ্জ্বল গায়ের রঙ। কিন্তু তুবার তো তা নয়। তুবার বাবা মাও বেশ হতাশ হয়ে পড়েছে তুবাকে নিয়ে। তুবা যদিও প্রথম দিকে মানসিক ভাবে বেশ শক্ত ছিলো, কিন্তু এতগুলো প্রস্তাব এসে কয়েকটা ওকে দেখতে এসে, ডিনাই করে দেয়ায় তুবাও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাবাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে বলল,
-বাবা, তোমরা এতো টেনশান কেন নিচ্ছো বলোতো?
-টেনশান নেবো না? বাবা হলে বুঝতি রে মা। এতোগুলো সম্বন্ধ আসলো কিন্তু একটাতেও কিছু করতে পারলাম না। আর তোর নিজেরও তো কোনো পছন্দ নেই যে, নিশ্চিন্তে সেখানে সম্বন্ধ পাকা করবো।
-এটা তো সম্ভব না বাবা। কলেজ লাইফে হয়তো সুযোগ ছিলো। কিন্তু ভার্সিটিতে উঠে তো আল্লাহ দ্বীনের বুঝ দিলেন। এসব হারাম সম্পর্কে তো কোনওমতেই জড়ানো সম্ভব না।
-হ্যা, তাতো ঠিকই। আল্লাহ তোকে আজীবন এমনভাবে দ্বীন মেনে চলার তাওফিক দিক মা।
বলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন রুবায়েত সাহেব।
-আমীন। তোমরা এতো হতাশ হয়ো না বাবা। আল্লাহ যা তাকদীরে রেখেছেন, তাই হবে। আল্লাহ যদি কারো জন্য আমাকে নির্ধারণ করে থাকেন, তবে আজ হোক আর কাল হোক তার সাথেই বিয়ে হবে বাবা। খামাখা দুশ্চিন্তা করে তোমরা অসুস্থ হয়ে পোড়ো না।

আল্লাহর উপর মেয়ের তাওয়াক্কুল দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন তুবার বাবা। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। আরো কয়েকটা প্রস্তাব আসলো, কিন্তু কালো বলে অনেক দ্বীনদার ছেলেরাও বিয়েতে রাজি হয় না। সবাই চায় দ্বীনদারির পাশাপাশি একটু সুন্দরী মেয়ে। খুব বেশি ফর্সা না হোক অন্তুত একটু উজ্জ্বল শ্যামলা।

চলবে...

নোট:
14. খুতওয়াতুশশাইত্বন হচ্ছে, শয়তানের দেখানো পথ বা এমন কাজ, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ নয়, কিন্তু বাস্তবে তা শয়তানের পাতানো ফাঁদ।
15. সূরা তালাক, আয়াত: ০৩

কালো মেয়ে"
--
শেষ পর্ব
.
তুবা বুঝে উঠতে পারে না, এরা দ্বীনদার হওয়া সত্ত্বেও কেন দ্বীনদারির থেকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের এতো গুরুত্ব দেয়। যখন দ্বীনের বুঝ ছিলো না, তখন বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিলো তুবার। স্বপ্ন দেখতো ফর্সা, সুন্দর, হ্যান্ডসাম একজন জীবনসঙ্গীর। এখনও যে মন চায় না, তা না। তবে আগের মতো সেই অন্ধ আকর্ষণটা এখন আর নেই। তাছাড়া ভারসাম্য না থাকলে দুজনার দাম্পত্য জীবনে সমস্যাও হতে পারে। সব মিলিয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে দ্বীনদারির মর্যাদা এখন তুবার কাছে অনেক বেশি। এখন তার কাছে একজন দ্বীনদার স্বামীর জীবনসঙ্গিনী হয়ে, তার হাতে হাত রেখে জান্নাতের দিকে ছুটে চলাটাই একমাত্র স্বপ্ন। এটাই এখন তুবার দৃষ্টিতে সফল জীবন। সে হোক কালো বা ফর্সা তাতে কী আসে যায়?
কিন্তু পড়াশুনা প্রায় শেষ। চাকরিবাকরি করারও ইচ্ছা নেই তুবার। বাবা মা চেষ্টা করেও বিয়ের কোনো ব্যবস্থা করতে পারছেন না। একটু একটু দুশ্চিন্তা হতে থাকে তুবার। দিনকেদিন দুচিন্তায় প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটা।
তবে আশাহত হয় না। আল্লাহ তো আছেন। তার হাতেই তো ভাগ্যের চাবিকাঠি। তার কাছেই মনের সব অব্যক্ত দুশ্চিন্তা আর আকুতিগুলো ব্যক্ত করে তুবা। আরো বেশি তাহাজ্জুদ, কুরআন পাঠ, দিনের নফল সালাতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করে তুবা। আবেগময় প্রার্থনা চলতেই থাকে। নিজের অসহায়ত্বকে নিবেদিত মনে সর্বাশয়ে তুলে ধরে মহান রবের দরবারে। ইয়া আল্লাহ! তুমিইতো সেই মহান সত্তা, যে তার এই অসহায় দাসীর একমাত্র সহায়। তুমিইতো সেই অন্তর্যামী প্রভু, যে তার এই অনুগতার হৃদয়ের আকুতি চোখেরজলের মাঝেই পড়ে নিতে পারে। একটা সময় দ্বীন বুঝতাম না। তুমিই হিদায়াত দিয়েছো। তোমার সাহায্য না থাকলে আজ ইসলাম মেনে চলাও হতো না আমার। সময়ের প্রয়োজনে আমার বাবা মা চাচ্ছেন তাদের মেয়েকে উত্তম পাত্রস্থ করতে। আমিও চাই দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে তোমার দেয়া হিদায়াতের পথে সেই মানুষটার হাত ধরে জান্নাত পানে ছুটে চলতে। কিন্তু পরিস্থিতি তো সবই তোমার জানা, হে আমার মালিক! যদি আমার জন্য তেমন কাউকে তুমি নির্ধারণ করে থাকো, তবে তা হবে আমার ও আমার পরিবারের জন্য আনন্দের। আর তুমি যদি আমার জন্য একাকী জীবন কাটানো উত্তম মনে করো, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকবো। জানবো আমি একা নই। আমার রব সর্বদা আছেন আমার সাথে। কিন্তু আমার বাবা মা এটা ভেবে কষ্ট পাবেন যে তাদের মেয়ে কালো বলে আজ তারা তাকে বিয়ে দিতে পারলো না। মানুষতো বোঝেনা, কালো ফর্সা এগুলো সৌন্দর্যের মাপকাঠি নয়, উভয়ই তোমার ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি উত্তম ফায়সালাকারী হে আল্লাহ!
কখনো কখনো জীবনঘনিষ্ঠ কিছু ব্যাপার যেমন মানুষকে জীবনের ব্যাপারে আরো বেশি তৎপর করে তোলে, তেমনি অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদাতও তুবার ইমানী সৌন্দর্যকে আরো লাবণ্যময় করে তুলতে থাকে।
কিছুদিন পর তুবার ভাইয়ার ট্রান্সফার হওয়াও সিলেট থেকে সস্ত্রীক বাড়িতে চলে আসে। তুবার ভাবিও বেশ খুশি হলো যে অনেকদিন পর আবার পরিবারের সাথে থাকা হবে। তুবাকে সে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। স্বামীর পরিবারইতো তার পরিবার।
তুবার ভাবি এসে শশুড়কে জানায়,
-বাবা, আমার এক বান্ধবীর সাথে সেদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো, ওর ছোটো ভাইয়ের জন্য ওরা একটা দ্বীনদার মেয়ে খুঁজছে। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। অনেক দ্বীনদার ছেলে। যদি আপনি অনুমতি দেন, তো তুবার ব্যাপারে ওদের সাথে কথা বলতে চাই।
-হ্যাঁ কথা বলতে পারো। তবে তুবার ডিটেইলস একটা সিভি পাঠিয়ে দিয়ো তাদেরকে। যাতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে আমাদের মেয়ে কিন্তু দেখতে তেমন ফর্সা না। তবে অনেক দ্বীনদার আলহামদুলিল্লাহ।
-হ্যাঁ, বাবা। শেষবার যখন আপনার ছেলের ছুটিতে বেড়াতে এসেছিলাম, তখনও দেখেছি। আর এখন তো আলহামদুলিল্লাহ তখনকার থেকেও এখন অনেক বেশি দ্বীনদার আমাদের তুবা। ওর দ্বীনের প্রতি জজবা সত্যিই হৃদয়গলানোর মতো। আমি নিজেও ওকে দেখে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি আমার বান্ধবীকে সব জানিয়েছি বাবা। ও বলেছে ওদের সুন্দরী চাই না। একটা ভালো দ্বীনদার মেয়ে চাই। সে কালো হলেও অসুবিধা নেই। আর আমাদের তুবাতো খুব বেশি কালো না।
-আচ্ছা, তাহলে তাদের সাথে কথা বলে তাদেরকে একদিন মেয়ে দেখতে আসতে বলো।
-আচ্ছা বাবা।
তুবার ভাবি রুমে গিয়ে বান্ধবীকে ফোন করে জানালো, তারা যেকোনো দিন মেয়ে দেখতে আসতে পারে। বান্ধবী বলল, বাসায় কথা বলে জানাবে যে কবে আসতে পারবে।
তারপর, দিন ঠিক করে একদিন তারা তুবাকে দেখতে এলো। ছেলের সাথে তার বড়ো আপু আর বাবা মা এসেছে। ছেলের নাম জারিফ মাহমুদ। সুন্দর মুখশ্রী। মুখের দাড়ি যেন যেই সৌন্দর্যকে পুরুষালি জৌলুস এনে দিয়েছে। জারিফের বাবাও তেমনই মার্জিত মানুষ। অধিকাংশ দাড়িই পাকা, কিন্তু সব এখনও শাদা হয়নি। উভয়ের পোশাকআশাকে তাকওয়ার ছাপ স্পষ্ট। জারিফের আপু আর মা দুজনেই পূর্ণ হিজাবে আচ্ছাদিতা। দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেলো তুবার পরিবারের সবার। নাস্তার পর্ব শেষ হলে, তুবার বাবা তাঁদেরকে মেয়ে দেখার অনুরোধ করলেন। জারিফের বাবা বললেন, মেয়ে দেখাতো শারঈভাবে ছেলে আর তার মা-বোনের জন্য অনুমিত। আমি বরং এখানেই অপেক্ষা করি ওরা দেখে আসুক।
জারিফ আর তার আপু ও আম্মুকে ভেতরের রুমে, তুবাকে দেখতে নিয়ে যাওয়া হলো। তুবার ভাইয়া ছিলেন তুবার সাথে। জারিফের আম্মুকে ওর আপু আগেই জানিয়েছে সবকিছু যে, মেয়ে শ্যামবর্ণা। উজ্জ্বলও নয় রঙ। তবে অনেক দ্বীনদার আলহামদুলিল্লাহ। তিনিও তাতেই বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি যা ভেবেছিলেন, এখন তুবাকে দেখে ভাবনার থেকে বেশ ভালোই লাগলো তার কাছে। এমনিতে তুবার মুখটা খুব মিষ্টি দেখতে। তুবার কাছে গিয়ে বসতেই তুবা উনাকে সালাম দিলেন। উত্তর দিয়ে উনি বললেন,
-তোমার নাম কী মা?
-তুবা।
-তুমি কি নিকাব-হাতমোজা সহ বোরখা পরো?
-জি।
-তা মা, তুমি কি মাহরাম - নন মাহরাম মেইন্টেইন করে চলো?
-জি আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন,
-মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে, জিনাত। এখন তুই আর জারিফ কথা বলে দেখ।
-আচ্ছা আম্মা। তুমি বরং তাহলে তোমার হবু বিয়েন সাহেবার সাথে গিয়ে কথা বলে এসো।
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তুবার ভাইয়া বললেন, আম্মু ঐপাশের রুমে আছে। বলে, তিনি রুম দেখিয়ে দিলেন।
একবার সলজ্জ চোখে জারিফ তাকালো তুবার দিকে। তারপর আপুর কানেকানে বলল,
-আমি সামনের রুমে যাচ্ছি আপু!
-কী? পছন্দ হয়েছে?
-আমার রিকুয়ারমেন্ট তো তুমি জানোই আপু। যাস্ট সুন্নাহ পালনের নিয়াতেই দেখতে আসা। কথা বলে, বোঝার চেষ্টা করো সে দ্বীনের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। তোমার পারফেক্ট মনে হলেই আমি চোখবুজে বিয়ে করে নেবো ইন-শা-আল্লাহ!
তুবা বুঝতে পারছে না, এরা মেয়ে দেখতে এসে কী এতো কানাঘুষা করছে। জারিফ তুবার ভাইয়াকে বলল,
-ভাইয়া, যদি কিছু মনে না করেন, চলুন আমরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। আপু আর উনি একটু কথা বলুক।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, অসুবিধা নেই চলুন।
এতোক্ষণ মাথা নীচু করে বসে ছিলো তুবা। জারিফ আর ওর ভাইয়া কথা বলার সময় প্রথমবারের মতো জারিফের দিকে তাকালো তুবা। আল্লাহু আকবার! এতো সুন্দর মানুষটা আমাকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে! এও নিশ্চয়ই অপছন্দ করে চলে যাবে। কিন্তু তাহলে আপুকে আবার কী কথা বলতে রেখে গেলো? জারিফের আপু উঠে গিয়ে তুবার পাশে বসলো। হাসিমুখে বলল,
-এই যে ভাবী সাহেবা! আমার সামনে লজ্জা পেতে হবে না। মুখটা তুলুন মুহতারামা।
মুখটা তুলে, মুচকি একটা হাসি দিয়ে তুবা বললো,
-আমি নই আপু! আপনি হলেন আমার কাছে মুহতারামা!
-সে পরে দেখা যাবে কে মুহতারামা। এখন বলো আমার ভাইকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে? ও মা-শা-আল্লাহ অনেক দ্বীনদার। নিজের ভাই বলে বলছি না, আমার জীবনে দেখা সবথেকে তাকওয়াবান পুরুষ আমার ভাই।
-উনাকে যে কারোই পছন্দ হবে আপু। উনিতো অনেক সুন্দর মা-শা-আল্লাহ! কিন্তু আমাকে হয়তো উনার পছন্দ হয়নি।
-না রে বোকা মেয়ে। ও অনেক লাজুক তো তাই উঠে চলে গেছে। আমাকে কথা বলতে বলেছে। তোমার ভাবীর কাছে তোমার ব্যাপারে যা শুনেছি তারপর খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি আর এখন দেখে যা মনে হচ্ছে, তাতে সবমিলিয়ে আমার কাছে তোমাকে পারফেক্ট মনে হয়েছে। আর আমার ভাইয়েরও এতেই মত আছে। সুতরাং এখন তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে বিয়েটা আজই পাকাপাকি করে যাবো আমরা।
কথাটা শুনে মনে এক পশলা ভালোলাগার বৃষ্টি বয়ে গেলেও, মুহূর্তেই দুশ্চিন্তার মেঘ মৃদু গর্জে উঠলো তুবার মনে।
-আমার কোনো আপত্তি নেই আপু। কিন্তু বাহ্যিক দিক থেকে কি আমি উনার যোগ্য?
-ফর্সা রঙে কি আর যোগ্যতা লেখা থাকে? শোনো তুবা! আমার ভাইটা প্রতিজ্ঞা করেছিলো, দ্বীনদারিতার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে, জীবনে একটা মেয়েকেই দেখবে, আর তাকেই বিয়ে করবে। ওর ইমানের লেভেলটা তোমাকে আর তাফসির করে বুঝাতে চাচ্ছি না বোন আমার! আমরাও তাই আসার আগে তোমার ব্যাপারে যথাসাধ্য খোঁজখবর নিয়েই এসেছি। তোমার পরহেজগারিতা আমাদের মনে ধরেছে। তোমার সুন্দর মনটা তোমার বাহ্যিকতাকে ছাপিয়ে গেছে। আমার ভাই চামড়ার সৌন্দর্য চায় না। এরকম একটা সুন্দর মন চায়। আর গায়ের রঙে কী আসে যায়। সাদা-কালো উভয়ইতো আল্লাহর সৃষ্টি। তাই আল্লাহ চাহে তো তুমিই ওর জন্য পারফেক্ট। আর তোমার মতো মেয়ের জন্য আমার ভাইও পারফেক্ট হবে ইন-শা-আল্লাহ। সুন্দরী খোঁজা চোখগুলো তোমার মতো মুত্তাকী হৃদয়ের মেয়ের জন্য বড়োই বেমানান।
আপুর কথাগুলো শুনে, দুশ্চিন্তার মেঘগুলো গর্জনধ্বনি থামিয়ে, প্রশান্তির বৃষ্টি বইয়ে দিলো তুবার মনে।
-তাহলে তুবা!
-জি আপু,
-তুমি মত দিচ্ছো তো?
-জি ইন-শা-আল্লাহ! এ আমার পরম সৌভাগ্য আপু!
-আলহামদুলিল্লাহ!
বলে, তুবাকে বাহুপাশাবদ্ধ করে আলিঙ্গন করলেন জিনাত আপু। এমন সময় তুবার ভাবী আসলো ওদের রুমে। দুই বন্ধবী অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুজনেই বেশ প্রীতি প্রকাশ করলেন। তারপর দুই পরিবারর বিয়ের দিনতারিখ ঠিকঠাক করার পর জারিফরা চলে গেলো।
কয়েকদিন পর। এক জুমাবারে মাসজিদে সুন্নাতী পরিবেশে বিয়ে হয়ে গেলো জারিফ ও তুবার। বিয়ের দিন আনন্দ, খুশি আর কৃতজ্ঞতার এক মিশেল অনুভূতিতে চোখের কোণেঘেঁষে জল চলে এলো তুবার। সবকিছু যেনো একটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো তার কাছে। জিনাত আপুর কথাটা মনে পড়তেই কেমন এক বিস্ময়াবিষ্টতা অনুভব হলো তুবার। জারিফ প্রতিজ্ঞা করেছিলো " একটা মেয়েকেই দেখবে আর তাকেই বিয়ে করবে"। ব্যাস আপু এতোটুকুই বলেছিলো। যার মানে হচ্ছে, কোনো মেয়েকেই সে দেখে না। আল্লাহর আদেশ মেনে নিজের দৃষ্টিকে সে সর্বদা হেফাজত করে চলে। সুবহানআল্লাহ! তুবাতো আল্লাহর কাছে শুধু একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী চেয়েছিলো। আর আল্লাহ তাকে, দ্বীনদারিতার পাশাপাশি এতো সুন্দর একজন জীবনসঙ্গী দিলেন, যার তাকওয়া আর ইমান তার সৌন্দর্যের থেকেও বেশি! সুবহানআল্লাহ! নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম ফায়সালাকারী। এজীবনে এমন একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী পেলে একটা মেয়ের আর কিইবা চাই?
তাওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং নিবেদিত মনে আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে অভ্যস্ত করায়, তুবার কালো হওয়া কিংবা অতীতের অজ্ঞতাপূর্ণ জীবন, এমন সুন্দর আকাঙ্ক্ষিত পবিত্র জীবনের পথে বাধা হতে পারেনি। এমন স্বপ্নপুরুষ, এমন ইমানদার একজন জীবনসঙ্গী, ক'টা সুন্দরী মেয়ের ভাগ্যে জোটে? কালো মেয়েকে তো অনেক ছেলেই বিয়ে করে তবে হয় সেটা, মেয়ের বাবার সম্পত্তি দেখে, নয়তো মেয়ের ভালো চাকরি দেখে। ক'জন আছে যারা শুধু মেয়ের চিত্ত লাবণ্যময়তা দেখে বিয়ে করে?


*★ সমাপ্ত ★*
কাল্পনিক শিক্ষামূলক গল্প: "কালো মেয়ে"

No comments:

Post a Comment